বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে নয়নতারায়। তখন আমরা ঢাকার নারিন্দার বসুবাজার লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতাম। আমি এখনও চোখ বন্ধ করলে আমাকে দেখি। ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন দিন এবং রাত্রির মাঝামাঝি প্রহরের মতো সময়ে সেই আমি ঘুরে বেড়ায় পাড়াময়।
শক্তি ঔষধালয়ের কারখানার পশ্চিম গা ঘেঁষে চলে গেছে রেললাইন। ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে গেণ্ডারিয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জ যায় ট্রেন ঝমঝম শব্দ করে। ট্রেনের হুইসল শুনে সেই আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে রেললাইনের দিকে। কখনও অবাক হয়ে দেখতে থাকে দ্রুতবেগে চলে যাওয়া গাড়িটার ছোট ছোট জানালার সারি। সেই ফ্রেমে আটকে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে, ওদের কাউকে আর কখনও সে দেখবে না। কখনও কখনও সে ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে গলা মিশিয়ে বলতে থাকে, ‘ঢাকা যাবো, মানুষ খাবো, ঢাকা যাবো, মানুষ খাবো’। তখন তার মনে হতে থাকে, সত্যিই বুঝি ট্রেনটা প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে এ রকম হিংস্র একটি ঘোষণা নিয়ে। ইঞ্জিনের সামনে মাথার ওপর বসানো একটা চোখ অনেকটা সিন্দাবাদের গল্পে পড়া একচক্ষুবিশিষ্ট দানবের মতো। ঘাড়ের ওপর একটা চিমনি আর তা দিয়ে কয়লার কালো ধোঁয়া দ্রুতবেগে উল্টো দিকে উড়ে গিয়ে ফিকে হয়ে ওপরের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই আমি ট্রেন চলে যাবার পর পর দ্রুত লাইনে হাত দিয়ে ঘর্ষণের উত্তাপ অনুভবের চেষ্টা করে। লাইনে কান পেতে ঝমঝম শব্দ শুনে বুঝতে চেষ্টা করে ট্রেনটা কতদূর গেল। শুনেছিলাম, পঞ্চাশের দাঙ্গায় নাকি মানুষ কেটে চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে ফেলে দেওয়া হতো। ওই সব মানুষের কঙ্কাল নাকি রেললাইনের ধারের জঙ্গলে খুঁজলে পাওয়া যাবে।
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী
আমাদের পাড়ায় এক জন জ্যাঠামশাই ছিলেন। চোখে গোল চশমা। ভারী কাচের ওপাশের চোখ জোড়া বড় হয়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, কেশবিরল মাথা, নিরুদ্দিষ্টপ্রায় দন্তপাটি, শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে, মুখমণ্ডলের বলিরেখায় দারিদ্র্যের সুস্পষ্ট চিহ্ন অঙ্কিত, পোড়া শরীর, পরনের ধুতিটি হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ঘরে বসে বড় একটা বঁটিতে জ্যাঠামশাই বাঁশের চটা চিরে চিরে ঝাঁটার শলা বানান। তার পর তার দিয়ে বাঁধেন। সেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে ছুটে যেতাম প্রায় প্রতি দিন দুপুরবেলা। দুপুরের ঘুম ফাঁকি দিয়ে বাড়ির বড়দের চোখ এড়িয়ে চলে যেতাম। জ্যাঠামশাই গল্প বলতে পারতেন অঙ্গভঙ্গি করে। কখনও বাঘের গল্প, কখনও ভূতের, কখনও রাজার। রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প কী চমৎকার করেই না বলতেন জ্যাঠামশাই! মনে হত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, রাম চলেছেন চৌদ্দ বছরের বনবাসে, দশরথ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, মন্থরা কানে কানে কথা বলছে কৈকেয়ীর। চোখের সামনে যেন দেখতে পেতাম শকুনি মামার পাশা খেলা, রথে করে চলেছেন অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ সারথি। এই জ্যাঠামশাই-ই বলেছিলেন রেললাইনের কথা। রাতের বেলা কখনও এ রেললাইন দিয়ে একা চলাচল করা উচিত নয়। যারা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে কিংবা বিভিন্ন সময় অপঘাতে যাদের মৃত্যু ঘটেছে ওরা সবাই রাতের বেলা রেললাইনে হাঁটাহাঁটি করে। জ্যাঠামশাই গল্পগুলো বলতেন আর আমি শিহরিত হতাম।
এক দিন সকালবেলা আমাদের বাড়িটা থমথমে। প্রতি দিনের মতো বই নিয়ে বসেছি আমরা। মা-খালা-ফুপুরা উঠোনে বসেছেন বঁটি নিয়ে তরকারি কুটতে। বাবা চলে গেছেন অফিসে। ভাইয়েরা যে যার কাজে। পড়া শেষ করে সাইকেলের চাকা নিয়ে গাড়ি-গাড়ি খেলছি। তখন ক’টা বাজছে? বড়জোর এগারোটা কি সাড়ে এগারোটা। আগের রাতেই বাড়ির বড়রা আলোচনা করেছিলেন, সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু ঘটে যেতে পারে পর দিন। অতএব, কেউ যেন শহরের দিকে না যায়। কিন্তু বাবা অফিসে চলে যাবার পর সে কথা আর কেউ শোনেনি। খবরটা এল বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটার দিকে। ইউনিভার্সিটিতে গুলি চলেছে ছাত্রদের ওপর। সবার মুখ শুকনো। যারা বাইরে গেছে তারা কে কোথায় আছে এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত সবাই। খোঁজ নেওয়ার কোনও উপায় নেই। গুলির কথা আমাকে বলেনি কেউ। আমার তখন সে বয়সও নয়। সবার চেহারা দেখে অনুমান করছিলাম শুধুমাত্র। কে যে খবর দিয়ে গেলেন জানি নে। শুধু দেখলাম, শব্দ শুনে সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ আর বিষাদের ছায়া। মা আমাকে বললেন, খবরদার দুষ্টুমি করবে না আর বাড়ির বাইরে যাবে না একটুও। আমি বাইরে গেলে পুলিশরা এসে ধরে নিয়ে যাবে— এমনি ভয়ও দেখানো হলো। কিন্তু আমার মনে তখন হাজার প্রশ্ন, পুলিশ কেন ধরে নিয়ে যাবে, পুলিশ কেন গুলি করবে? পুলিশরা দেখতে কেমন? পুলিশ সম্পর্কে যে চেহারার কথা আমাকে বলা হয়েছিল তা অনেকটা এ রকম— পুলিশের খাকি হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা শার্ট পরা, মোটা পাকানো ভুরুর নীচে গোল গোল লালচে চোখ, ঠোঁটের ওপর ভারী গোঁফ, মাথায় টুপি, হাতে লাঠি।
সবাই গম্ভীর মুখে কথা বলছিলেন আর আমি তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। বাড়িতে তখন আশপাশের অনেকে এসেছে খবর শুনতে। হঠাৎ আমার এক মামা এলেন হন্তদন্ত হয়ে। এত ক্ষণ যে কথাটি ভাসা ভাসা শোনা যাচ্ছিল, এত ক্ষণে সেটার একটা সঠিক তথ্য পাওয়া গেল। আমার মামা ক্লান্ত হয়ে সিঁড়ির ওপর বসলেন, এক গ্লাস পানি চাইলেন। আমি উঠোনে চাকা চালাতে চালাতে শুনছিলাম কথা। যতটুকু বুঝছিলাম তাতে মনে হচ্ছিল পুলিশ ছাত্রদের রাস্তায় বেরোতে দিচ্ছিল না। কিন্তু ছাত্ররা সে কথা শোনেনি বলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, অনেককে ধরেও নিয়ে গেছে। এ কথা শোনার পর রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে গেছে মিছিল করে। আমি সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম এবং আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছিল। কেন গুলি করবে পুলিশ? যাকে গুলি করল সে তো মরে গেল। কেন সে মরবে? দু’তিন দিন আগে আমার এক ভাই সন্ধ্যেবেলা আমাকে গল্প শোনাতে গিয়ে বলেছিলেন, ছাত্ররা নাকি বাংলা ভাষায় কথা বলতে চায়, মাকে মা বলে ডাকতে চায়, সে জন্যই তাদের ওপর পুলিশরা রেগে গেছে। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমি তা হলে কী করব? আমি তো আর কোনও ভাষায় কথা বলতে পারি না, আমি তো মাকে অন্য কোনও ভাবে ডাকতে শিখিনি। অজ্ঞাতসারেই আমার মনে হয়েছিল, ছাত্ররা যা করছে ঠিকই করছে। কিন্তু আমার তো তখনও ঠিক কিংবা বেঠিক বিচারের বয়স হয়নি। সে দিন দুপুরবেলায় বাবা যখন গুলির কথা বলছিলেন, তখন আমার ভেতরকার সাত বছরের দুরন্ত শিশুটি মুহূর্তেই যেন কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু তখন সতর্ক কয়েক জোড়া চোখ আমাকে পাহারা দিচ্ছে যেন। আমি বুঝে উঠতে পারছি না আমার কী করা উচিত। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থিরতা আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি একছুটে বেরিয়ে গেলাম বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায়। ছুটতে ছুটতে বসুবাজারের গলি পেরিয়ে সোজা গলির মোড়ে। সেখানে যজ্ঞেশ্বর পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালার সামনে বসে ছিল আমাদের শুকুর মিয়া রিকশাওয়ালা। রিকশার ওপর পা তুলে বসে অপেক্ষা করছিল কোনও যাত্রীর। তাকে এতটুকু সময় না দিয়ে আমি তার রিকশার পেছনের ডান দিকের চাকার পাম্প খুলে দিলাম। হা হা করে উঠল শুকুর মিয়া। ও দিকে তত ক্ষণে আমার পেছনে পেছনে এসে উঠেছেন আমার মামা, আমার এক কাজিন এবং আরও কে কে যেন। আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হল বাড়িতে। মামার বুকের ওপর এক টুকরো কালো রঙের চারকোনা কাগজ। তাতে লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আমার চোখের সামনেই সেই কালো কাগজটা অকস্মাৎ যেন বিশাল এবং বিস্তৃত হতে হতে ঢেকে ফেলল সমগ্র আকাশ, সমগ্র পৃথিবী। আর সেই কাগজে লেখা কথাগুলো আশ্চর্য রকমের শক্তিমান হয়ে নাচতে থাকল চোখের ওপর। আমি তখন দু’হাতে চোখ ঢেকে আছি আর মামার দু’হাতে বন্দি হয়ে তাঁর কোলে চেপে দুলতে দুলতে যাচ্ছি পঁচিশ নম্বর বসুবাজারের সেই ছোট পরিসরের কারাগারের দিকে। ওই অল্প বয়সে বুঝিনি, একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তের ভেতরে বীজ বপন হয়ে গেল নতুন একটি দেশের।
একুশের চেতনার হাত ধরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরও শাণিত হল, স্বাধীনতার বিস্ময় অরুণের উদয় ঘটল মাত্র ১৯ বছরের ভেতরে। যদিও স্বাধীনতার পর অনেক রকম চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে, বিচিত্র সব ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে, বাংলাদেশকে পার করতে হয়েছে ৪৫টি বছর। ষড়যন্ত্র নবতর অবয়বে ডানা মেলে, আর তাকে ছিন্ন করতে শক্তি জোগায় একুশ।
আমাদের সবচেয়ে বড় স্বস্তি এখানে যে, এখনও প্রতি বছর একুশ আসে নতুন এক শিহরণে। সেই শিহরণকে ভাষার ফ্রেমে আটকানো যায় না, প্রকাশ করা যায় না এর অভাবিত অনুভবকে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানুষ তাঁর শৈশব কৈশোর যৌবন পার করে একুশের ভেতর থেকে— বাঙালি বাংলাভাষা আর বাংলাদেশকে ভালবাসার দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। একুশ এখনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে রোখার সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন, সবচেয়ে শক্তিশালী এক অব্যর্থ দাওয়াই।
একুশ এখন মহীরুহ। একুশ প্রতি বছর টপকে যাচ্ছে নিজের উচ্চতাকে। একুশ এক অহর্নিশ অনির্বাণ শিখা, যার কারণে মসীকৃষ্ণ অমানিশাতেও পথ হারায় না বাংলাদেশ। হারাবেও না কোনও দিন।
(আবেদ খান সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার)