উর্জিত পটেল
নতুন অর্থবর্ষের প্রথম ঋণনীতিতে মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকির কথা ভেবে সুদ কমানোর পথে হাঁটলেন না রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেল। তবে একই সঙ্গে নোট বাতিলের জেরে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ঘরে আসা বাড়তি নগদ থেকে অতিরিক্ত আয়ের পথ প্রশস্ত করলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার পটেলের এই সিদ্ধান্তে শিল্পমহলের একাংশ আরবিআইয়ের সাবধানী নীতির প্রশংসা করলেও অনেকেই সুদ কমানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাদের দাবি, ব্যাঙ্কগুলির উচিত হাতে আসা বাড়তি তহবিল কম সুদে ঋণ দিয়ে অর্থনীতিতে নগদের জোগান বাড়ানো। শেয়ার সূচক আরবিআই সুদ না-কমানোয় সামান্য পড়লেও সাধারণ ভাবে স্থিতিই বজায় ছিল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এটি ছিল উর্জিত পটেলের তৃতীয় দফার ঋণনীতি পর্যালোচনা। তিন বারই পটেল সুদ কমানোর রাস্তায় হাঁটলেন না।
এ দিন ঋণনীতির পর্যালোচনায় পটেল প্রথমত, ৬.২৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখলেন রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ দেওয়ার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে-হারে সুদ নেয়)। দ্বিতীয়ত, নোট-কাণ্ডের জেরে ব্যাঙ্কের হাতে আসা অতিরিক্ত নগদ লগ্নির সুযোগ করে দিতেই রিভার্স রেপোর হার (ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে-হারে সুদ দেয়) ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬% করলেন।
রিভার্স রেপো রেট বাড়িয়ে ব্যাঙ্কের আয়ের রাস্তা খোলার পাশাপাশি তাদের খরচ কমাতে মার্জিনাল স্ট্যান্ডিং ফেসিলিটি (এমএসএফ)-র হারও ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। অতি অল্প সময়ের (সাধারণত ১ দিন) জন্য ঋণ নেওয়ার সময়ে (সরকারি ঋণপত্র গচ্ছিত রেখে) ব্যাঙ্কগুলিকে যে-হারে সুদ দিতে হয়, তাকেই বলে এমএসএফ। প্রতিদিন আমানত এবং ঋণের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে হয় ব্যাঙ্কগুলিকে। এর জন্য অনেক সময়েই অতি অল্প সময়ের জন্য ঋণ নিতে হয় তাদের। এই ঋণ ‘কল মানি’ হিসাবেও ব্যাঙ্কিং মহলে পরিচিত।
এইসঙ্গেই নির্মাণ শিল্পে ব্যাঙ্কের তহবিল লগ্নির রাস্তাও খুলে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে তা করতে হবে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইটিএস)-এর মাধ্যমে।
এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি ভাস্কর সেনের মতো ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞরা। রিভার্স রেপো বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ।
তবে বেশ কিছু দিন ধরেই আরবিআইয়ের অভিযোগ, তারা ইতিমধ্যেই সুদ যতটা কমিয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার কমায়নি। অর্থাৎ তা কমানোর সুযোগ এখনও রয়েছে তাদের। এ ব্যাপারে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি দেবব্রত সরকার বলেন, ‘‘সুদ স্থির করার ক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, তা অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক। ঋণনীতির আগেই তারা কমিয়েছে সুদের হার।’’
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি নোট-কাণ্ডের পরে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাঙ্কের হাতে আসা বাড়তি নগদ ছিল ৭,৯৬,৬০০ কোটি টাকা। মার্চের শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৩,১৪,১০০ কোটি টাকায়। একে তো শিল্প-ঋণের চাহিদা নেই, তার উপর হঠাৎ হাতে চলে আসা অতিরিক্ত নগদ লগ্নি করাই ব্যাঙ্কগুলির কাছে এখন বড় সমস্যা। সে কথা মাথায় রেখেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রিভার্স রেপো বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেবব্রতবাবু বলেন, ‘‘এর ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ঋণ দিয়ে ওই অতিরিক্ত নগদ টাকার কিছুটা সুরাহা করার সুযোগ পাবে ব্যাঙ্কগুলি।’’
ঋণনীতি ফিরে দেখতে গিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে যে, ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছরে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭.৪% হবে। ২০১৬-১৭ সালে যা ছিল ৬.৭%।
অন্য দিকে মূল্যবৃদ্ধি চলতি অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে ৪.৫% ও দ্বিতীয়ার্ধে ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা শীর্ষ ব্যাঙ্কের। তবে কেন্দ্রীয় কর্মীদের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে বেতন বৃদ্ধির জেরে মূল্যবৃদ্ধি ১০০ থেকে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। জিএসটি চালু হলে তা-ও ইন্ধন জোগাতে পারে মূল্যবৃদ্ধিতে। সেই কারণেই সাবধানী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, এই কারণেই বৃদ্ধির পূর্বাভাস নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েও সুদের হারে স্থিতাবস্থা রেখেছে আরবিআই। অ্যাসোচ্যাম প্রেসিডেন্ট সন্দীপ জাজোদিয়া বলেন, বাড়তি নগদ কাজে লাগানোয় গুরুত্ব দিয়েছে আরবিআই।
ঋণ মকুবের বিপক্ষে পটেল: উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার ৩৬ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করার পরিপ্রেক্ষিতে উর্জিত পটেল হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এ ধরনের প্রকল্প সৎ ভাবে ধারশোধ করার সংস্কৃতিটাই নষ্ট করে দেয়।