সপ্তাহ দুই হল গুজরাতের সুরাত থেকে হাওড়ায় নিজের গ্রামে ফিরেছেন সনাতন মণ্ডল। নগদের আকালে সারা দেশেই গয়নার চাহিদা তলানিতে। সোনার কারিগর সনাতনবাবু তাই জানেন না, কাজে ফেরার ডাক আসবে কবে। পকেটে টাকা নেই। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। স্বাভাবিক ভাবেই সংসার খরচ যতটা সম্ভব ছাঁটাই করেছেন। পাড়ার দোকান থেকে ছোটদের জন্য চকোলেট, ক্রিম বিস্কুট কেনা প্রায় বন্ধ। গিন্নির জন্য শ্যাম্পুর বোতলের বদলে এসেছে তার ছোট প্যাকেট (স্যাসে)। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেলের মতো যেগুলি না কিনলে নয়, তার বাইরের অধিকাংশ পণ্যই বাদ পড়েছে ফর্দ থেকে।
হাওড়ায় শুধু নয়, এই ছবি এ রাজ্যের প্রতিটি জেলার প্রায় প্রতি গ্রামে। বলা ভাল, সারা দেশেই। দু’বছর পরে এ বার ভাল বর্ষা হওয়ায় আশা ছিল যে, গ্রামে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়বে। ভাল বিক্রিবাটার হাত ধরে জমিয়ে ব্যবসা করবে চটজলদি ব্যবহারের ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারক বা এফএমসিজি (কেক, বিস্কুট, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি) সংস্থাগুলি। কিন্তু নোটের আকালে সেই আশা শুকিয়ে গিয়েছে। কার্ড, ই-ওয়ালেট ব্যবহারে তুলনায় সামান্য দড় শহরে ধাক্কা কিছুটা কম। কিন্তু সেখানেও কেনা-বেচায় যেন ব্রেক কষেছে কেউ। ফলে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাচ্ছে ওই ভোগ্যপণ্য সংস্থাগুলি। কাটছাঁট করছে বিপণন বাজেটও।
নোট বাতিলের ঘোষণার পরেই অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, এর দরুন খদ্দের কমে যাওয়ায় প্রথমে দোকানিদের মাথায় হাত পড়বে। তাঁরা জিনিসপত্র না-কেনায় বিক্রিবাটা কমবে পাইকারি বাজারে। এ ভাবে সামগ্রিক ভাবে চাহিদায় ভাটা পড়লে তখন উৎপাদন ছাঁটাইয়ে বাধ্য হবে সংস্থাগুলি। কাজ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে অনেক কর্মীর। তখন আবার সেই কর্মীরা জিনিসপত্র কেনা কমাবেন। তখন চাহিদা আরও কমবে। এ ভাবে দুষ্টচক্রে আটকে পড়বে দেশের অর্থনীতি। সেই আশঙ্কাই সত্যি হওয়ার লক্ষণ এখন ফুটে উঠছে।
এ দেশে চটজলদি ব্যবহারের ভোগ্যপণ্যের বাজারে ৭২% শতাংশ লেনদেনই হয় নগদে। উপদেষ্টা সংস্থা এ সি নিয়েলসেনের সমীক্ষা অনুযায়ী, শহরে মাত্র ১% মুদিখানা ও মনোহারি দোকানে কার্ড ব্যবহার হয়। গ্রামে নগদ নির্ভরতা আরও বেশি। ফলে নোট বাড়ন্তের জেরে রংচটা বাজারের ছবি ফুটে উঠছে সর্বত্র।
আর এরই মাসুল গুনে উৎপাদন কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে ব্রিটানিয়া, পার্লের মতো সংস্থা। দেশে বিস্কুট বাজারের মাপ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তার অর্ধেকেরও কম সংগঠিত ক্ষেত্রের দখলে। ওই সংগঠিত বাজারে প্রথম সারির সংস্থা ব্রিটানিয়ার কর্তৃপক্ষই ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন কমানোর কথা জানাচ্ছেন। একই পথে হেঁটেছে পার্লে। তাদের দাবি, চাহিদা কমে যাওয়ায় এই মুহূর্তে উৎপাদন ছাঁটাই করা ছাড়া উপায় নেই। একই কারণে প্রায় ৩০% পণ্য কম তৈরি করছে আনমোল বেকার্স। গ্রামে যাদের বিক্রি অনেকখানি।
এক ঝটকায় ২০% বিক্রি কমার কথা জানিয়েছে ডাবর। বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়েছে তারা। একই রাস্তায় হেঁটেছে ইমামি। রিগলে ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম ভি নটরাজনও বলছেন, ‘‘ব্যবসা ১৫% মার খেয়েছে। বিক্রি কমেছে পাইকারি ও খুচরো বাজার দু’জায়গাতেই।’’
গ্রামে উপস্থিতি কিছুটা কম হওয়ায় আঁচ তুলনায় কম লেগেছে স্থানীয় কেক-বিস্কুটের ব্র্যান্ড বিস্কফার্মের গায়ে। তবে তাদেরও বিক্রি কমেছে ১০%। সংস্থার কর্ণধার বিজয় সিংহের দাবি, ‘‘এখন সমস্যা হলেও ভবিষ্যতে নগদহীন বাজারে ঝুঁকি কমবে।’’
৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার সপ্তাহ দুই-তিনের মধ্যে করা এ সি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, বিক্রিবাটা কমেছে দেশের ৭০% দোকানে। গ্রামে বিক্রি গোত্তা খেয়েছে ৬০-৭০ শতাংশ। তখনকার তুলনায় পরিস্থিতি এখন কিছুটা শুধরেছে ঠিকই। কিন্তু বাজারের হাল ফেরার আশার আলো দেখা যাচ্ছে না এখনও।
উপদেষ্টা সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর মতে, চলতি বছর ভোগ্যপণ্য শিল্পের তেমন ভালো কাটেনি। সেপ্টেম্বরে বিক্রি বেড়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু বর্ষা ভাল হওয়ায় আশা ছিল গ্রামের বাজার ভাল হওয়ার। সেই সঙ্গে শহরেরও। ক্রেতা টানতে সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল বিপণন বাজেটও। কিন্তু নোট নাকচের জেরে ওই পরিকল্পনা এখন শিকেয়। গোদরেজ কনজিউমার প্রোডাক্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিবেক গম্ভীর জানান, বিক্রিবাটা বাড়ার আশায় জল ঢেলেছে নোট সঙ্কট। তাই টান পড়েছে বিপণন বাজেটেও।
তবে আকারে ছোট হলেও উল্টো ছবিও একটা আছে। নোট বাতিলের পরে কার্ডে কেনাকাটা করতে পাড়ার দোকান ছেড়ে বিগ বাজার, স্পেনসার্সের মতো খুচরো বিপণির দিকে পা বাড়িয়েছেন অনেকে। ফিউচার গোষ্ঠীর কর্তা দেবেন্দ্র চাওলা জানান, আগের থেকে তাঁদের মজুত বাড়াতে হয়েছে ২৫%।
কিন্তু দেশের কত শতাংশ মানুষ শপিং মলে চাল-ডাল বাজার করেন? কার্ডে কেনেন কুমড়ো? হাওড়ার গ্রামে তা আছেই বা কোথায়?