Coronavirus Lockdown

ছয় ফান্ডে তালা, দাওয়াই কই

রাক্ষুসে করোনার সঙ্গে লড়াই করে ঋণের বাজারে প্রাণ ফেরাতে শুধু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ ছাঁটাইয়ের তলোয়ার যথেষ্ট নয়।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২০ ০৬:১৫
Share:

ছবি: সংগৃহীত

রাক্ষুসে করোনার সঙ্গে লড়াই করে ঋণের বাজারে প্রাণ ফেরাতে শুধু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ ছাঁটাইয়ের তলোয়ার যথেষ্ট নয়। শিল্প তথা অর্থনীতির গায়ে লকডাউনের ক্ষত সারাতে জরুরি সরকারি ত্রাণের মলমও। ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটন ইন্ডিয়ার ছয় ডেট ফান্ডে একলপ্তে তালা পড়ে যাওয়া এই জোড়া খামতিকেই ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।

Advertisement

যে সব সংস্থার ধার শোধের সম্ভাবনা (ক্রেডিট রেটিং) কম, তাদের ঋণপত্রের কতটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে ওই ছয় ফান্ড বেশি টাকা ঢেলেছিল, ভবিষ্যতে তা হয়তো খতিয়ে দেখবে নিয়ন্ত্রক। কিন্তু লগ্নি-বাজারে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া এই ঘটনায় মাথাব্যথার কারণ ঋণপত্রের চাহিদার অভাব আর লগ্নিকারীদের আস্থা টোল খাওয়াও।

ডেট ফান্ড মূলত টাকা ঢালে ঋণপত্রে। সেখানে পাওয়া সুদ ও বন্ড কেনাবেচা করে হওয়া মুনাফাই লগ্নিকারীদের রিটার্ন হিসেবে ভাগ করে দেয় তারা। ধরা যাক, ‘ক’ সংস্থার ঋণপত্রে ১০০ টাকা ঢেলেছে ফান্ড। তার মানে ব্যবসার কাজকর্ম চালাতে ওই ১০০ টাকা ধার নিয়েছে ‘ক’। তার জন্য সুদ গুনবে তারা। কিন্তু করোনার ছোবলে ব্যবসাই যেখানে বন্ধ, সেখানে তারা যে সময়ে সুদ-সহ টাকা ফেরাবে, তার নিশ্চয়তা কী? আর সেই নিশ্চয়তা যত কম, তত কম তার ঋণপত্রের কদরও (বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ সংস্থার)। বাজারে তার ক্রেতা নেই। ফ্র্যাঙ্কলিন ঠিক এ কথাই জানিয়েছে।

Advertisement

করোনার আক্রমণের আগেই অর্থনীতি ঝিমিয়ে ছিল। লকডাউনের পরে শিল্প, বিশেষত ছোট-মাঝারি সংস্থা একেবারে বিধ্বস্ত। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির কথায়, “এই পরিস্থিতিতে ছোট-মাঝারি শিল্প ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য ত্রাণ জরুরি ছিল। দরকার ছিল তাদের জন্য একেবারে কম সুদে কার্যকরী মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল)। তাতে ভর্তুকি জোগাতে হলেও আপত্তি নেই। একমাত্র তবেই এই কঠিন পরিস্থিতিতে ভেসে থাকতে পারত তারা। জোড়া লাগতে পারত ছিঁড়ে যাওয়া জোগান-শৃঙ্খলও। সেই সঙ্গে প্রয়োজন দরিদ্র, কাজ খোয়ানো শ্রমিক, দিন আনা-দিন খাওয়া মজুরদের হাতে সরাসরি টাকা জোগানো। যাতে চাহিদার চাকা না-বসে।” কিন্তু কেন্দ্র এখনও যেটুকু ত্রাণের কথা বলেছে, তা নগণ্য বলে অভিযোগ অনেকেরই।

বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ শৈবাল বিশ্বাসের বক্তব্য, “টাকা সুরক্ষিত থাকার ভরসাতেই ব্যাঙ্ক বা ফান্ডে টাকা রাখেন মানুষ। তেমনই এই সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও চলে এই ভরসায় যে, এক সঙ্গে জমানো টাকা তুলবেন না সকলে। কিন্তু লগ্নিকারীদের আস্থা টোল খেলে, এক সঙ্গে অনেকে ছুটবেন টাকা তুলতে। বিপদে পড়বে ফান্ড, এমনকি ব্যাঙ্কও।” ফ্র্যাঙ্কলিনে যা হয়েছে। তাই করোনার এই কঠিন সময়ে কেন্দ্র অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফেরাতে দাওয়াই না-দিলে, ওই আস্থা অটুট থাকা ক্রমশ কঠিন হবে বলে তাঁর আশঙ্কা।

ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটনের ঘোষণা


মার্কিন মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থার ভারতীয় শাখা ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটন ইন্ডিয়া। নিজেদের ছ’টি ডেট ফান্ড (যারা মূলত ঋণপত্রে লগ্নি করে) রাতারাতি বন্ধ করেছে তারা। জানিয়েছে, ২৩ এপ্রিল থেকে কেউ যেমন নতুন করে সেগুলিতে লগ্নি করতে পারবেন না, তেমনই নিজের টাকাও তুলে নিতে পারবেন না কেউ! সেখানে আপাতত আটকে লগ্নিকারীদের প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা।

কোন ছয় ফান্ড?

১) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া লো ডিউরেশন ফান্ড, ২) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া ডায়নামিক অ্যাক্রুয়াল ফান্ড, ৩) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া ক্রেডিট রিস্ক ফান্ড, ৪) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া শর্ট টার্ম ইনকাম প্ল্যান, ৫) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া আল্ট্রা শর্ট বন্ড ফান্ড, ৬) ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্ডিয়া ইনকাম অপরচুনিটিজ় ফান্ড।

বন্ধ কেন, সংস্থার যুক্তি?

করোনা হানায় অর্থনীতি টালমাটাল। ফান্ডে টাকা
ফেলে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না অনেক লগ্নিকারী। ফলে মেয়াদ শেষের আগেই তা রিটার্ন সমেত ফেরত চাইছেন একসঙ্গে অনেকে।

সে ক্ষেত্রে উপায় এবং তার জেরে সমস্যা দু’টি—

• ব্যাঙ্কের থেকে বেশি সুদে ধার নেওয়া। কিন্তু একসঙ্গে বহু লগ্নিকারীর জন্য তা করতে গেলে বিপুল ক্ষতি।
• লগ্নিকারীদের টাকা ফান্ড যে বন্ড বা ঋণপত্রে খাটায়, তা বেচে টাকা মেটানো। কিন্তু এখন বিগড়ে রয়েছে বন্ডের বাজার। বর্তমান অবস্থায় প্রায় অসম্ভব ঠিক দরে ক্রেতা পাওয়া। বিশেষত বেশি ঝুঁকির ঋণপত্রে।
• তাই এই সিদ্ধান্ত।

তা হলে টাকা গায়েব?

• সংস্থার দাবি, এখন জলের দরে বন্ড বেচে কিছু জনকে টাকা মেটালে, সমস্যায় পড়বেন বাকিরা। তাই তা না-করে ঋণপত্রে জমা টাকা খাটানো এবং সুযোগ বুঝে তা বিক্রির কাজ চালিয়ে যাবেন ফান্ড ম্যানেজার। তাতে যখন যেমন টাকা আসবে, তা লগ্নিকারীদের ভাগ করে দেওয়া হবে লগ্নির আনুপাতিক হারে।

আশ্বাস ও দাবি

• ফান্ডগুলির সংগঠন এএমএফআই-এর দাবি, এটি কয়েকটি বেশি ঝুঁকির ডেট ফান্ডের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অধিকাংশ ডেট ফান্ডই টাকা খাটায় বেশি সুরক্ষিত ঋণপত্রে। এই ছয় ফান্ডে আটকে পড়া টাকাও দেশে সমস্ত ফান্ডে খাটা মোট তহবিলের ১.৪ শতাংশের কম। তাই ‘অযথা’ শঙ্কিত হয়ে সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে না-ছোটাই ভাল। তাতে বরং বিপত্তি। ব্রোকারদের অবশ্য দাবি, বাজারে আস্থা ফেরাতে হস্তক্ষেপ করুক অর্থ মন্ত্রক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন