টাটা-রাজ্যে রদবদল, সাইরাসকে সরিয়ে রাশ ফের রতনের হাতে

তাবড় কর্পোরেট দুনিয়াকে চমকে দিয়ে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দিল টাটা গোষ্ঠী। অন্তর্বর্তী কর্ণধার হিসেবে ফিরলেন ৮০ ছুঁইছুঁই রতন নভল টাটা-ই। সেই রতন টাটা, ২১ বছর রাজ্যপাট সামলানোর পরে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে যাঁর কাছ থেকে ব্যাটন নিয়েছিলেন সাইরাস।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১০
Share:

সাইরাসকে সরিয়ে সামনে আবার রতন টাটা। চার বছর পর ফের টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদে।

তাবড় কর্পোরেট দুনিয়াকে চমকে দিয়ে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দিল টাটা গোষ্ঠী। অন্তর্বর্তী কর্ণধার হিসেবে ফিরলেন ৮০ ছুঁইছুঁই রতন নভল টাটা-ই। সেই রতন টাটা, ২১ বছর রাজ্যপাট সামলানোর পরে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে যাঁর কাছ থেকে ব্যাটন নিয়েছিলেন সাইরাস।

Advertisement

টাটা গোষ্ঠীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, সাইরাসকে সরানোর কথা ঠিক করেছে তাদের হোল্ডিং (মূল) সংস্থা টাটা সন্স। সিদ্ধান্ত হয়েছে সোমবারই, পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে। টাটা সন্স ও টাটা গোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা ভেবেই এই পরিবর্তন। এ দিনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়ে এই পট বদলের কথা জানিয়েছেন খোদ রতন টাটা। দায়িত্ব নেওয়ার পরে কর্মীদের লেখা এক চিঠিতেও টাটা জানিয়েছেন যে, গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখেই এই দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন তিনি।

একই সঙ্গে, এ দিন রতন টাটা-সহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গড়েছে পর্ষদ। বাকিরা হলেন টিভিএস-কর্তা বেণু শ্রীনিবাসন, বেন ক্যাপিটালের ডিরেক্টর অমিত চন্দ্র, আমেরিকায় প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রণেন সেন ও উপদেষ্টা কুমার ভট্টাচার্য। এঁদের দায়িত্ব চার মাসে নতুন চেয়ারম্যান খুঁজে বার করা। সেই দৌড়ে নাম ভেসে উঠছে পেপসি-র কর্ণধার ইন্দ্রা নুয়ি, ভোডাফোনের প্রাক্তন সিইও অরুণ সারিন, টিসিএস-কর্তা এন চন্দ্রশেখরন, টাটা ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার তথা রতন টাটার সৎভাই নোয়েল টাটা প্রমুখের।

Advertisement

পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার আগে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় নারাজ কর্পোরেট কর্তারা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, পৃথিবী জুড়ে ব্যবসা ছড়িয়ে থাকা এত বড় গোষ্ঠীতে রাতারাতি এমন বদল এবং অবসরে চলে যাওয়া শীর্ষ কর্তাকেই ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ঠিক কী বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে নানা জল্পনা উড়ছে সবখানে।

টাটা গোষ্ঠীর মূল সংস্থা হল টাটা সন্স। ‘টাটা’ ব্র্যান্ড-নাম এবং ট্রেডমার্কেরও মালিক তারা। টাটাদের সংস্থাগুলি ব্যবসা করে এর শাখা হিসেবে। এই টাটা সন্সেরই প্রায় ১৮.৫% মালিকানা নির্মাণ সংস্থা শাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠীর হাতে। টাটা ট্রাস্টস-এর অংশীদারি ৬৬%। অবসর নেওয়ার পরেও পুরোদস্তুর সক্রিয় ভাবে যার দেখভাল করেছেন রতন টাটা। এ ছাড়া, টাটা সন্সের ১৩% অংশীদারি রয়েছে বিভিন্ন টাটা সংস্থার কাছে। বাকিটা টাটা পরিবারের সদস্যদের হাতে। এই শাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পালোনজি মিস্ত্রিরই ছেলে সাইরাস। তাই চার বছর আগে সাইরাসকে বেছে নেওয়ার পিছনে ওই নির্মাণ সংস্থার উপর টাটাদের দীর্ঘ দিনের নির্ভরতা এবং দু’পক্ষের বিশ্বাসের অটুট বন্ধনেরই ছায়া দেখেছিল শিল্পমহল। সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে সাইরাসকে শীর্ষ পদ থেকে কী ভাবে ও কেন সরানো হল, সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবখানে। তবে ডিরেক্টর হিসেবে তিনি থাকছেন।

এই চিঠিই পেলেন সংস্থার কর্মীরা।

সংস্থা সূত্রের খবর, পর্ষদে সাইরাস সমেত ন’জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রস্তাব যেহেতু চেয়ারম্যানকে নিয়ে, তাই সাইরাসের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু বাকি ৮ জনের কেউ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি। ছ’জন সরানোর প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। মত দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন দু’জন।

টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ পদ নিয়ে প্রবল লড়াই সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা গিয়েছে একবারই। রতন টাটার সঙ্গে টাটা স্টিলের বর্ণময় প্রাক্তন কর্ণধার রুসি মোদীর দড়ি টানাটানির সময়। লড়াই গড়িয়েছিল তিক্ততায়। কিন্তু অনেকের ধারণা, এ বারের পট বদল আরও ‘রক্তক্ষয়ী’ হওয়ার সম্ভাবনা। বিভিন্ন সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই আইনি পথ খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে শাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠী। সাইরাসদের মতে, কোনও নোটিস ছাড়া এ ভাবে সরিয়ে দেওয়ার এই পদক্ষেপ বেআইনি। উল্টো দিকে, সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে টাটারাও না কি কথা বলেছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম, প্রাক্তন সলিসিটার জেনারেল মোহন পরাসরনের সঙ্গে। যদিও কলকাতার আইনি উপদেষ্টা সংস্থা খেতান অ্যান্ড কোম্পানিজের সিনিয়র পার্টনার এন জি খেতানের মতে, ‘‘টাটা সন্সের বোর্ড-ই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তা চ্যালেঞ্জের সুযোগ শাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠীর নেই।’’

এই আইনি কচকচির বাইরে গিয়েও সকলে আগে জানতে চাইছেন যে, হঠাৎ কেন এ ভাবে রাতারাতি সরতে হল সাইরাসকে? সংস্থার হাল ধরার জন্য ফিরতে হল অবসরে চলে যাওয়া ৭৮ বছরের রতন টাটাকেই?

পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসার অঙ্ক আগের বছরের ১০,৮০০ কোটি ডলার থেকে কমে হয়েছে ১০,৩০০ কোটি ডলার। ২০১৬ সালের মার্চের হিসেব অনুযায়ী, নিট ঋণের বোঝাও এক বছর আগের ২,৩৪০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ২,৪৫০ কোটি ডলারে। কিন্তু ডামাডোলের বিশ্ব বাজারে শুধু এই বিচ্যুতির জন্য সাইরাসের গদি হারানো কষ্টকল্পনাও।

কেউ বলছেন, টাটা গোষ্ঠীর পরিচালন পদ্ধতি নিয়ে প্রায়শই টাটা ট্রাস্টস-এর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না সাইরাসের। আবার অনেকের কথায়, দুনিয়াজুড়ে অলাভজনক ব্যবসা বন্ধ বা বিক্রি করার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছিলেন তিনি। যেমন, ইস্পাতের চাহিদায় ভাটা এবং সস্তার চিনা ইস্পাতের সঙ্গে দামের লড়াইয়ে এঁটে উঠতে না-পারার কারণে ব্রিটেনে জলের দরে সেই ব্যবসা বিক্রির সিদ্ধান্ত সম্প্রতি নিয়েছে টাটা স্টিল।

নিজের জমানায় একের পর এক বিদেশি সংস্থা অধিগ্রহণের মাধ্যমে টাটা গোষ্ঠীকে আক্ষরিক অর্থেই বহুজাতিক করতে চেয়েছিলেন রতন টাটা। ২০০০ সালে ব্রিটিশ চা সংস্থা টেট্‌লি দিয়ে শুরু। এর পর ২০০৪ সালে দেয়ু-র বাণিজ্যিক গাড়ি। ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুরের ন্যাটস্টিল। ২০০৭ সালে চোখ কপালে তুলে দিয়ে ১,২০০ কোটি ডলারে ইস্পাত বহুজাতিক কোরাস। ২০০৮ সালে ২৩০ কোটি ডলারে ফের ব্রিটিশ গাড়ি সংস্থা জাগুয়ার-ল্যান্ডরোভার। সেখানে ব্রিটেনে সাইরাসের ইস্পাত ব্যবসা গোটানোর মতো সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর ভাল না-লেগে থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

সাইরাসের আগে শুধু একজনই টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধারের পদ সামলেছিলেন (১৯৩২-’৩৮), যাঁর পদবীতে ‘টাটা’ ছিল না। তাঁর নাম নৌরজি সাকলাতওয়ালা। তবে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজির ভাগ্‌নে। সাইরাসও পারিবারিক ভাবে টাটাদের ঘনিষ্ঠ। তাঁর বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নোয়েল টাটার। কিন্তু তা সত্ত্বেও টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ পদে সাইরাসের জমানা ৪ বছরের বেশি স্থায়ী হল না। ফিরলেন রতন টাটা।

হাতে গড়া সংস্থার হাল খারাপ দেখে প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধারদের অবসর ভেঙে ‘কাজে ফেরা’র নজির দেশে-বিদেশে নতুন নয়। ২০১৩ সালেই ইনফোসিসের হাল ফেরাতে কিছু দিনের জন্য তার রাশ ধরেছিলেন এন আর নারায়ণমূর্তি। উত্তরসূরি হিসেবে খুঁজে এনেছিলেন বিশাল সিক্কাকে। ধুঁকতে থাকা অ্যাপলে রাজসিক প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল স্টিভ জোবসের। বিভিন্ন সময়ে এই একই পথে হেঁটেছেন গুগ্‌লের ল্যারি পেজ, কফি চেন স্টারবাক্‌সের হাওয়ার্ড শুলজ্‌, অ্যামাজনের জেফ বেজোস প্রমুখ। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ার অনেকে বলছেন, এঁদের থেকে রতন টাটার ঘটনা অনেকটাই আলাদা। প্রথমত, তিনি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নন। আর দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও টাটা গোষ্ঠীকে আর যা-ই হোক ধুঁকতে থাকা বলা চলে না।

সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে সাইরাস বলেছিলেন, ‘‘সঠিক কারণে এবং সহানুভূতির সঙ্গে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেলে চলবে না।’’ দেখা যাচ্ছে, কঠিন সিদ্ধান্তের কুঠার নেমে এল তাঁর উপরই। প্রথা ভেঙে হাঁটতে চাওয়াই কি কমিয়ে দিল টাটা কর্ণধার হিসেবে তাঁর আয়ু? উত্তরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে কর্পোরেট জগৎ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement