এটিএমের বাইরে দীর্ঘ প্রতিক্ষা। ছবি: পিটিআই।
৮ নভেম্বর ২০১৬। ১৩০ কোটির আম আদমিকে চমকে দিয়ে পাঁচশো এবং হাজারের নোট বাতিল করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কালো টাকার উপর কেন্দ্রের এই 'কার্পেট বম্বিং'-এ কালো টাকার কারবারিদের উপর আদৌ কতটুকু চাপ হল তা ভবিষ্যত বলবে, কিন্তু চরম আতান্তরে পড়লেন সাধারণ নাগরিকরা। আর এই সমগ্র পর্বে প্রবল চাপ সামলাতে হল ব্যাঙ্ক কর্মীদের। দিন রাত এক করে পরিস্থিতি সামলানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করলেন তাঁরা। আবার টাকা না পাওয়া গ্রাহকের নিষ্ফল আক্রোশও গিয়ে পড়ল সেই তাঁদের উপরেই। যেমন বাহবা পেলেন, তেমনই জুটল অপমানও।
ব্যাঙ্কের বেশির ভাগ কর্মচারীর তত্পরতায় পরিস্থিতি যখন কিছুটা স্বাভাবিক, তখনই সামনে এল কে মাইকেলের নাম। বেঙ্গালুরুতে কর্মরত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট। অবৈধ ভাবে প্রায় দেড় কোটি টাকা বদলাতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লেন তিনি। দেশের বেশ কিছু ব্যাঙ্ক থেকে টুকটাক গরমিলের খোঁজ অবশ্য আগেই মিলছিল। কিন্তু স্বয়ং রক্ষকই যে ভক্ষক হয়ে উঠবেন তা বোধহয় ভাবেননি কেউই। তদন্তে নেমে সিবিআই, ইডি, দুর্নীতিদমন শাখার অফিসাররা দেখেছেন, বিভিন্ন উপায়ে এক দল অসাধু ব্যাঙ্ক কর্মচারীর মদতে কালো টাকা রাতারাতি হয়ে গিয়েছে সাদা। জোগান থাকা সত্ত্বেও বাজারে তৈরি হয়েছে টাকার হাহাকার।
কী ভাবে চলত এই কারবার? বিশেষজ্ঞ এবং তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, মোটামুটি সাত রকম ভাবে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে এই সময়টা জুড়ে।
১) ব্যাঙ্কে থাকা পুরনো পরিচয়পত্র দিয়ে নোট বদল:
ব্যাঙ্কে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে সচিত্র পরিচয়পত্র আবশ্যিক। অ্যাকাউন্ট খুলে গেলে সেই পরিচয়পত্র থেকে যায় ব্যাঙ্কের কাছে। গ্রাহকের এই পরিচয়পত্রগুলি দিয়েই পুরনো নোট বদল করেছেন ব্যাঙ্কের একদল কর্মী। সিবিআইয়ের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কর্নাটক ব্যাঙ্কের ইন্দিরানগরের চিফ ম্যানেজার সূর্যনারায়ণ বৈরী গ্রাহকদের এই পরিচয়পত্র দিয়েই পুরনো নোট বদলেছেন। এর বদলে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের কমিশন।
২) পুরনো পরিচয়পত্র দিয়ে জাল অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা লেনদেন:
শুধুমাত্র নোট বদল করাই নয়, ব্যাঙ্কের হাতে থাকা সচিত্র পরিচয়পত্র দিয়ে জাল অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। অ্যাকাউন্টগুলিকে ব্যবহার করে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে। কাজ হয়ে গেলে ওই অ্যাকাউন্টগুলি ব্যাঙ্কের নিজস্ব নিয়মেই এক সময়ে বন্ধ হয়ে যেত।
৩) জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে:
জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যে কালো টাকা সাদা করার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে, তার আঁচ প্রথম থেকেই পাচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। দেখা গিয়েছে, নোট বাতিল পরবর্তী পর্যায়ে ১০-১৫ শতাংশ জনধন অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণে টাকার লেনদেন হয়েছে। এই ধরনের সব লেনদেনে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
৪) ডিম্যান্ড ড্রাফ্টের মাধ্যমে:
কালো টাকা সাদা করার আর একটি অসাধারণ পদ্ধতি হল ডিম্যান্ড ড্রাফ্ট। ব্যাঙ্কের নিয়মানুযায়ী ৫০ হাজারের নীচের কোনও ডিম্যান্ড ড্রাফ্টে পরিচয়পত্র লাগে না। এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে এক দল লোক ডিম্যান্ড ড্রাফ্ট কেটে সেটিকে ক্যানসেল করাতে শুরু করে। এর ফলে কোনও পরিচয়পত্র ছাড়াই নোট বদল করা সম্ভব হচ্ছিল। সম্প্রতি এমনই দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তাঁরা ১৪৯টি ডিম্যান্ড ড্রাফ্ট বানিয়ে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা বদলে ফেলেছিলেন। এই ঘটনার পর সিবিআই নোট বাতিল পরবর্তী সব ডিম্যান্ড ড্রাফ্ট পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৫) প্রমাণপত্র ছাড়াই টাকা লেনদেন:
গ্রাম এবং মফসসলে এক দল অসাধু ব্যাঙ্ক কর্মচারী কোনও রকম প্রমাণপত্র ছাড়াই টাকা পাল্টে দিতে শুরু করেন। তার বদলে নেওয়া হচ্ছিল মোটা কমিশন। টাকা বদলের পর সেটিকে ব্যাঙ্কের গচ্ছিত সম্পদ হিসাবে দেখানো হত। এই পদ্ধতিতেই কাজ করতেন দিন কয়েক আগে ধরা পড়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মচারী কে মাইকেল।
আরও পড়ুন: এক মাসে বদলে গেল চাঁদমারিই! কালো টাকা নিয়ে এখন মুখে কুলুপ
৬) ফাঁকা এটিএমের ক্যাশের মাধ্যমে:
নোট বাতিল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই দেশের অর্ধেক এটিএমে ঝুলছে ‘নো ক্যাশ’য়ের বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা অনুযায়ী, বেশিৱ ভাগ এটিএমে কয়েক দিনের মধ্যে নতুন টাকা এসে যাওয়ার কথা। তা হলে ‘টাকা নেই’-য়ের বিজ্ঞপ্তি কেন? তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছে, এটিএমে ভরার জন্য আসা টাকার বেশ কিছুটা অংশ ঘুরপথে চলে যেত কালো টাকার কারবারিদের কাছে। এই ভাবেই ধনলক্ষ্মী ব্যাঙ্কের প্রায় দেড় কোটি টাকা-সহ ধরা পড়েন এক সরকারি অফিসার। ওই টাকা ব্যাঙ্কের ৩২টি এটিএমে যাওয়ার কথা ছিল।
৭) কোঅপারেটিভের মাধ্যমে:
টাকার রং পাল্টাতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে মাইক্রো ফিনান্স এজেন্টদেরও। একই সঙ্গে বেশির ভাগ কোঅপারেটিভে যেহেতু এখনও কাজ হয় লেজার বুকে, তাই পুরনো তারিখের এন্ট্রি দেখিয়ে বদলানো হয়েছে টাকা। বিষয়টি নজরে আসতেই কোঅপারেটিভগুলিতে নোট বদল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।