ইন্দ্রা নুয়ি।
এত দিনে দুই মেয়ের সঙ্গে একটু গুছিয়ে বসে গল্প করার সময় পেলেন ইন্দ্রা নুয়ি!
টানা ১২ বছর পেপসির চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসারের (সিইও) দায়িত্ব সামলানোর পরে ৩ অক্টোবর ওই পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। ৬২ বছরের নুয়ির উত্তরসূরি হিসেবে ইতিমধ্যেই স্পেনের র্যামন ল্যাগুর্তার (৫৪) নাম ঘোষণা করে দিয়েছে মার্কিন নরম পানীয় বহুজাতিকটি। একই সঙ্গে জানিয়েছে, ২০১৯ সালের গোড়া পর্যন্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব থাকছে নুয়ির হাতেই।
কর্পোরেট দুনিয়া বলছে, এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটা আস্ত যুগে পর্দা পড়তে চলেছে পেপসিতে। যেখানে ২৪ বছর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন নুয়ি। কিন্তু তাঁর পরিচিতি কখনও শুধু এক বিশাল বহুজাতিকের কর্ণধারের বৃত্তে আটকে থাকেনি। বরং গত অন্তত দেড় দশক ধরে তিনি ভারতীয় মেধার বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির অন্যতম জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি কর্পোরেট দুনিয়ায় এই উচ্চতার ক্ষমতার অলিন্দে কড়া নেড়েছেন এত স্পষ্ট ভাবে। শীর্ষে পৌঁছনোর অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। ভেঙে চুরমার করেছেন ‘গ্লাস সিলিং’— এই বিশ্বাস, যে বড় কর্পোরেট সংস্থার বোর্ড রুমে একচেটিয়া আধিপত্য পুরুষদেরই।
শিল্পমহলের অনেকে মনে করাচ্ছেন, ২০০৬ সালে নুয়ি যখন পেপসির তখ্তে বসছেন, তখন মহিলা কিংবা ভারতীয়, দু’য়ের কারোরই বহুজাতিকের শীর্ষে বসার ‘রেওয়াজ’ তেমন ছিল না। হাতে গোনা ব্যতিক্রম বলতে ম্যাকিনসের রজত গুপ্ত কিংবা ভোডাফোনের অরুণ সারিনের মতো কিছু নাম। গত এক দশকে কিন্তু সেই ছবি অনেকটাই পাল্টেছে। জিএম, আইবিএম-সহ বেশ কিছু বহুজাতিকের শীর্ষেই এখন মহিলা। তেমনই মাস্টার কার্ড, মাইক্রোসফট, গুগ্লও নিশ্চিন্ত বোধ করেছে অজয় বাঙ্গা, সত্য নাদেল্লা, সুন্দর পিচাইয়ের মতো অনাবাসী ভারতীয়ের নেতৃত্বে। নিশ্চুপ প্রেরণা হিসেবে কোথাও নুয়ি এবং পেপসিতে তাঁর সফল ইনিংস থাকল কি? চায়ের কাপে তুফান তোলার পক্ষে এ বিষয় বোধহয় মন্দ নয়।
পরিচিতি
• জন্ম চেন্নাইয়ে। মাদ্রাজ ক্রিশ্চান কলেজ থেকে স্নাতকের পাঠ
• এমবিএ পড়েছেন আইআইএম-কলকাতায়
• ম্যানেজমেন্টের উচ্চতর পাঠ আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে
• মোটোরোলা এবং এশিয়া ব্রাউন বোভারি-তে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে
• ১৯৯৪ সালে পেপসিতে যোগদান। ২৪ বছর সেখানেই
• ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট এবং চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও)
• ২০০৬ সালে সিইও। পরের বছর সঙ্গে চেয়ারপার্সনের দায়িত্বও।
• এ ছাড়া, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের বোর্ডের সদস্য। রয়েছেন ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ইত্যাদিতেও
আরও বেশি করে এই তর্ক উঠতে পারে এই কারণে, যে ব্যবসায় তিনি এত দিন নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেখানে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে লড়তে হয়েছে কোকাকোলার মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর গলাকাটা প্রতিযোগিতার সঙ্গে। তা সামলে সিইও থাকাকালীন শেয়ারহোল্ডারদের ১৬২% রিটার্ন দিয়েছেন তিনি। সংস্থার বার্ষিক ব্যবসার অঙ্ক ৩,৫০০ কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছেন ৬,৩৫০ কোটি ডলারে। শুধু তা-ই নয়, ঝুঁকি নিয়ে একের পর এক সংস্থা অধিগ্রহণের পথে হেঁটেছেন। শুধু সোডা নির্ভর ব্যবসা থেকে বেরোতে ‘হেল্থ’ এবং স্পোর্টস ড্রিঙ্কের দিকে ঝুঁকেছেন। জোর দিয়েছেন পট্যাটো চিপসের মতো স্ন্যাক্সে। এখন পেপসির আয়ের এক বড় অংশ আসে কিন্তু ওই সব ব্যবসা থেকেই।
এ জন্য অবশ্য কম ত্যাগও করতে হয়নি তাঁকে। এক সময় চরম ব্যস্ততার জন্য নাকি মেয়েদের সে ভাবে সময়ই দিতে পারেননি। বহু সময়ে সেই ‘অপরাধ বোধ’ কুরে খেয়েছে তাঁকে। চাকরিতে বড় সাফল্যের খবর বলতে গিয়ে নিজের মায়ের কাছেই শুনেছেন, ‘‘আগে একটু দুধ কিনে আনো দেখি! ও সব চাকরির কথা গ্যারাজেই ফেলে এস। মনে রেখ, এখানে আগে তুমি স্ত্রী, মা, পুত্রবধূ।’’ যেমন আর পাঁচ জন মেয়ে শোনেন। তবে সেই দুধ আনতে গিয়ে ‘পেপসির ক্যান’ ফেলে দিতে হয়নি তাঁকে।
এক সাক্ষাৎকারে ইন্দ্রা বলেছিলেন, ‘‘মেয়েদের প্রায়ই বলি, তবেই খেলতে যেতে পার যদি সব কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে। ওটাই আমার জীবনদর্শন।’’ সিইও হিসেবে সেই কাজ সম্ভবত তাঁর শেষ। খোঁজ নতুন চ্যালেঞ্জের। দুই মেয়ের সঙ্গে এত দিনে একটু আয়েস করে চেয়ার টেনে গল্প করার সময় পেলেন তিনি।