রায়গঞ্জের বাজারে বিক্রি হচ্ছে তুলাইপাঞ্জি চাল। —নিজস্ব চিত্র
এতদিনে দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় উত্তর দিনাজপুরের সুগন্ধী তুলাইপাঞ্জি চাল। তারই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে জেলায়। কৃষি দফতরের পরামর্শ মাথায় রেখেই বিশ্ব বাজারে বাজিমাতের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন জেলার ধান চাষিরা। তুলাইপাঞ্জি চাল রফতানির উদ্যোগ নিতে কেন এত দেরি সেই প্রশ্নটাও উঠছে একই সঙ্গে।
কৃষি বিপণন দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “বাসমতি চাল রফতানির অনুমতি থাকলেও এতদিন তুলাইপাঞ্জি, গোবিন্দভোগ এগুলি রফতানির অনুমতি ছিলনা। ২০১১ সালের পরে উদ্যোগী হয়ে এই অনুমতি জোগাড় করেছি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে তুলাইপাঞ্জি চাল রফতানির চেষ্টা।” বিভিন্নভাবে প্রচারের ফলে দেশের বাইরে ক্রেতা মেলায় এ বার তুলাইপাঞ্জি ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানিয়েছেন।
শুরুটা ছিল লন্ডন অলিম্পিক। যোগদানকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের জন্য তিন দিনের ফুড ফেস্টিভ্যালে রাজ্য থেকে পাঠানো হয়েছিল তুলাইপাঞ্জি চাল। সেই খাদ্য উৎসবে তুলাইপাঞ্জির রূপ, রস আর গন্ধ মন টেনেছিল খাদ্যরসিকদের। জেলার কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এরপরেই ভারতের প্রতিবেশী বেশ কয়েকটা দেশ তো বটেই এমনকী ইউরোপের কয়েকটা দেশও তুলাইপাঞ্জি চাল আমদানির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। হেমতাবাদের ব্লক কৃষি আধিকারিক শ্রীকান্ত সিংহ জানান, সাত-আট মাস আগে দিল্লি থেকে চাল ব্যবসায়ীদের একটি দল হেমতাবাদ ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় তুলাইপাঞ্জি ধানের চাষ পরিদর্শন করেন। এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যে তুলাইপাঞ্জি চাল আমদানির ব্যাপারে আগ্রহী, এই প্রতিনিধি দলটির কাছেই সেই বার্তা পায় জেলার কৃষি ও কৃষি বিপণন দফতর। তারপরেই নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে তুলাইপাঞ্জি চালের সুগন্ধ ও গুণগত মান যাতে কোনও ভাবেই নষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করার শর্তও চাপান ব্যবসায়ীদের এই দলটি।
কৃষি দফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী , উত্তর দিনাজপুর জেলার মোট ৬৩৯০ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার টন তুলাইপাঞ্জি ধানের চাষ হয়। জুলাই মাস জুড়ে বীজতলা তৈরির কাজ করেন চাষিরা। অগস্ট মাসে জমিতে চারা রোপণের কাজ চলে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ধান ওঠে। প্রতি বিঘা জমিতে অন্য ধান চাষে যেখানে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা খরচ হয় সেখানে তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ করতে চাষিদের খরচ পড়ে বিঘা প্রতি আড়াই হাজার টাকা। জেলার বিভিন্ন হাটে ও বাজারে চাষিরা প্রতি মণ ধানের দাম পান ১২০০ টাকা। বিঘা প্রতি ধান বিক্রি করে চাষিদের লাভ হয় পাঁচ থেকে ছ’হাজার টাকা। তুলাইপাঞ্জি চাল বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে চাষিদের লাভের এই অঙ্ক একলাফে অন্তত দ্বিগুণ বাড়বে বলেই আশা কৃষি দফতরের। বরাবরই তুলাইপাঞ্জি ধান চাষে জেলার কৃষকেরা আগ্রহী হলেও সরকারি বিপণন ব্যবস্থার অভাবে কোণঠাসা অবস্থা তাঁদের। কৃষকদের অভিযোগ, হাট ও বাজারগুলিতে ফড়েদের দাপটে এই ধানের উপযুক্ত দাম পান না তাঁরা। বিদেশের ব্যবসায়ীরা চাল কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করায় কৃষি দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে খুশি কৃষকরাও।
বিদেশে তুলাইপাঞ্জি চাল রফতানির সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখন উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন কৃষি দফতরের কর্তারা। একইসঙ্গে চালের সুগন্ধ ও গুণগত মান ধরে রাখতে বর্তমানে কৃষি দফতরের আধিকারিক ও প্রযুক্তি সহায়কেরা জেলা জুড়ে চাষিদের জৈব সার প্রয়োগ করে চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ড্রাম সিডার পদ্ধতিতে তুলাইপাঞ্জি ধানের বীজ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে অঙ্কুর তৈরি করে তা সরাসরি জমিতে রোপণ করার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। কৃষি দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন,অতীতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের জেরে তুলাইপাঞ্জি ধানের ফলন কমে যাওয়ার পাশাপাশি চালের গন্ধ ও গুণগত মানও কমে গিয়েছিল। অথচ চাষিদের ঘরে জৈব সারের অভাব নেই। আর তুলাইপাঞ্জি ধানে রোগপোকার আক্রমণ তেমন না হওয়ায় কীটনাশক প্রয়োগেরও খুব একটা দরকার পড়েনা। তাঁদের দাবি, ড্রাম সিডার পদ্ধতিতে চাষ করলে একদিকে যেমন চালের সুগন্ধ ও গুণগত মান বজায় থাকবে, তেমনই চাষের খরচ কমে যাওয়ায় ধান বিক্রি করে বিঘা প্রতি প্রায় দেড় হাজার টাকা অতিরিক্ত লাভ পাবেন চাষিরা।
হেমতাবাদের বিষ্ণুপুর ও আগাপুর এলাকার দুই চাষি সুলেমান আলি ও সাহাদাদ হোসেন এ বছর চার ও ১৩ বিঘা জমিতে তুলাইপাঞ্জি ধান চাষের পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, কৃষি দফতরের পরামর্শে এ বছর থেকে ড্রাম সিডার পদ্ধতিতে চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। জেলার উপ কৃষি অধিকর্তা জ্যোতির্ময় বিশ্বাস বলেন, “জেলায় তুলাইপাঞ্জি ধানের বিপণন কেন্দ্র না থাকায় চাষিরা আশানুরূপ দাম পান না। দেশ-বিদেশের উদ্যোগপতিরা উৎসাহী হলে তুলাইপাঞ্জি চাল রফতানি করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। প্রয়োজনে সরকারি নজরদারিতে চাষিরাই সরাসরি উদ্যোগপতিদের হাতে চাল তুলে দেবেন।”