ভরসা আইনই

সর্বস্ব দিয়ে যে-ছেলেকে পড়িয়েছেন, তার কাছেই হয়তো আজ আপনি বোঝা। পাশের পাড়ায় থেকেও খবর নেয় না মেয়ে। বয়সের ভারের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আর্থিক অনটন। কী করবেন? জানাচ্ছেন জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়সর্বস্ব দিয়ে যে-ছেলেকে পড়িয়েছেন, তার কাছেই হয়তো আজ আপনি বোঝা। পাশের পাড়ায় থেকেও খবর নেয় না মেয়ে। বয়সের ভারের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আর্থিক অনটন। কী করবেন? জানাচ্ছেন জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৭ ০২:৪১
Share:

স্বামী, স্ত্রী আর বাচ্চার ছোট্ট সংসারে এখন জায়গা হয় না অনেক বাবা-মায়েরই। কথাটা সরাসরি বলতে খারাপ লাগে। কিন্তু আজকের এই ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’র যুগে তা ঘোর বাস্তব। এর জন্য বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মনের কষ্টের কথা না হয় বাদই দিলাম। তার বাইরেও এই কারণে প্রবল আর্থিক অনটনের মুখে পড়তে হয় অনেককে।

Advertisement

যে বাবা-মা নিজের সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে সন্তানকে ভাল জায়গায় পড়িয়েছেন, শেষ বয়সে ক্রমশ বেড়ে চলা ওষুধের খরচ জোগাড় নিয়ে ভাবতে হয় তাঁদের। কিছুতেই আর নতুন চশমার টাকা জোগাড় করে ওঠা যায় না। ছেলে-মেয়ের হয়তো সপ্তাহান্তে শপিং মলে খরচই কয়েক হাজার। কিন্তু বুড়ো বাবা-মায়ের জন্য সামান্য কিছু টাকাও হাত দিয়ে গলে না। আজকের আলোচনা এই সমস্যা নিয়েই। মনে রাখবেন, এই সমস্ত ঘটনাই কিন্তু বয়স্কদের প্রতি অন্যায়। আর যেখানে অন্যায়, সেখানে বাঁচতে আপনার একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে আইনই। তাই মুখ বুজে এই অন্যায় সহ্য করার বদলে নিজের অধিকার চিনুন। জেনে রাখুন এই সংক্রান্ত আইনের গোড়ার কথা।

মনে হতে পারে, এই আলোচনা এখানে কেন? উত্তর সোজা। ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে অন্তত কতটুকু ভরণপোষণের খরচ আইনি ভাবে আপনার প্রাপ্য, এই লেখায় তার উপর আলো ফেলতে চেয়েছি আমরা। দেখতে চেয়েছি, কখন খোরপোষ দাবি করা সম্ভব? শেষ বয়সের জন্য টাকা জমানোর রাস্তা চিনে রাখার মতো এই অধিকার সম্পর্কে সজাগ থাকাও কিন্তু অসম্ভব জরুরি।

Advertisement

সংবিধান বলছে

মনে রাখবেন, এ দেশে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে। আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য হোক কিংবা শারীরিক-মানসিক অসহায়তা— যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই যাতে আইন বয়স্ক মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে, সেই রাস্তা তৈরি রাখা হয়েছে ভারতের সংবিধানে। যেমন—

•২১ নম্বর অনুচ্ছেদে যে-কোনও মানুষের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার বা জীবনের অধিকার স্বীকৃত।

• ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদ রাজ্য সরকারগুলিকে শিক্ষা, কর্ম এবং জন-সহায়তার বিষয়গুলিতে (যেমন বেকারত্ব, বার্ধক্য, অসুস্থতা ও প্রতিবন্ধকতাজনিত বিভিন্ন ক্ষেত্র) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলে।

• ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদ বলে সমাজের দুর্বল এই শ্রেণিকে সমস্ত রকম সামাজিক ও অন্যান্য ধরনের শোষণ থেকে রক্ষা করতে।

এই সবের আওতাতেই কিন্তু প্রবীণরা পড়েন। শেষ বয়সে ছেলে-মেয়ে না-দেখলে এবং সেই সঙ্গে নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য তেমন না থাকলে, অনেকেই ভীষণ অসহায় বোধ করেন। তাই সংবিধানে লেখা অধিকারগুলি জানা থাকলে, কিছুটা মনের জোর বাড়ে। প্রয়োজনে কড়া নাড়া যায় আইনের দরজায়।

আইনের কথা

বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকম আইনের শরণাপন্ন হতে হয়। তাই সেগুলি সম্পর্কে আগাম ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। যাতে বুঝে নেওয়া যায় নিজের হক। তাই চলুন এ বার সেই সব আইনেই চোখ রাখি—

মেন্টেন্যান্স অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্স অ্যাক্ট

প্রায় নতুন আইন। বেশির ভাগ জনেরই তাই এটি সম্পর্কে এখনও তেমন কিছুই জানা হয়ে ওঠেনি। তবে বয়স্কদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে এটি বেশ জোরালো। এই আইনে:—

• ‘সিনিয়র সিটিজেন’ বা প্রবীণ নাগরিক বলতে ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের কোনও ভারতীয় নাগরিককে বোঝানো হয়েছে।

• এর মাধ্যমে ছেলে, মেয়ে, পৌত্র বা দৌহিত্র এবং পৌত্রী বা দৌহিত্রীর কাছে মেন্টেন্যান্স বা ভরণপোষণের খরচ বাবদ খোরপোষ চেয়ে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।

• তবে নাবালক হলে, তার কাছে ওই আবেদন করা যায় না।

• আবেদন করতে পারেন পালক পিতা-মাতা এবং সৎ বাবা-মা’ও।

• নিঃসন্তানরাও তাঁর সম্পত্তির মালিক হবেন, এমন কারও কাছে খোরপোষ দাবি করতে পারেন।

• নির্দিষ্ট ট্রাইব্যুনালে গিয়ে অথবা আপনার এলাকার সাব-ডিভিশনাল অফিসারের কাছে গিয়ে নিজেই দরখাস্ত করতে পারে। এর জন্য কোনও আইনি মারপ্যাঁচ জানারও প্রয়োজন নেই।

• মাসে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত খোরপোষ মিলতে পারে।

• ইচ্ছাকৃত ভাবে বাবা-মাকে দেখাশোনা না-করলে এবং সেই অপরাধ প্রমাণ হলে, তিন মাস পর্যন্ত কারাবাস অথবা ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

• সাধারণ ভাবে অপরাধ ঘটলে, তা পুলিশের আওতাধীন এবং জামিনযোগ্য।

• রাজ্য সরকারগুলিকে অসহায় বয়স্ক মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই (ওল্ড এজ হোম) তৈরি করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজন পড়লে, সে রকম সুবিধা আছে কি না, খোঁজ নিতে হবে।

• একই ভাবে চিকিৎসা সংক্রান্ত সুরক্ষা দিতেও সরকার দায়বদ্ধ। সে কথা মাথায় রাখুন।

• সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একজন অফিসার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে (মেন্টেন্যান্স অফিসার)। সে বিষয়ে খোঁজ নিন।

• অনেক সময়ে দেখা যায় বাবা-মা সম্পত্তি ছেলে-মেয়েদের দানপত্র করে দিয়েছেন। এই আশায় যে, তারা তাঁদের ভাল রাখবে, দেখাশোনা করবে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে তা হয় না। এই আইনের ২৩ নম্বর ধারা বলছে, যদি সম্পত্তি দানপত্র করে দেওয়ার পরে ছেলে-মেয়েরা দেখাশোনা না-করেন, তা হলে দানপত্রটি বাতিল ঘোষণা করে সেই সম্পত্তি বা-মা আবার ফেরত নিতে পারেন। তবে শর্ত হল, দানপত্রে লেখা থাকতে হবে যে, সম্পত্তি দান করার অন্যতম শর্ত: ছেলে-মেয়েরা দেখাশোনা করবে।

এই আইনটি এ ভাবে আগাম সম্পত্তি দিয়ে বিপাকে পড়া বাবা-মায়ের রক্ষাকবচ। তবে এ ক্ষেত্রে দু’টি কথা মনে রাখা জরুরি—

(১) দানপত্র করার ক্ষেত্রে সব সময়ে সাবধান। সম্পত্তি হাতে আসার পরেও সন্তান আদৌ দেখবে কি না, অবশ্যই সেই চিন্তা আগে করুন।

(২) যদি দানপত্র করেনই, তবে তার বয়ান যেন ঠিক হয়। যাতে বেগতিক বুঝলে তা বাতিল করে ফের সম্পত্তি নিজের হাতে নিতে পারেন।

হিন্দু অ্যাডপশন অ্যান্ড মেন্টেন্যান্স অ্যাক্ট-১৯৫৬

• এই আইনটির ২০ নম্বর ধারায় ছেলে এবং মেয়েকে তাঁদের অশক্ত, বয়স্ক বাবা-মাকে দেখাশোনা করার আইনি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

• বাবা-মা বলতে এখানে কিন্তু সৎমার কথাও বলা হয়েছে।

গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণ

অনেকের ধারণা, বধূরাই বোধহয় এই আইনে সুরক্ষার আওতায় পড়েন। কিন্তু আসলে মায়েরাও এই রক্ষাকবচের সুবিধা নিতে পারেন। সন্তানের কাছে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে, গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইনে (২০০৫) আদালতে যাওয়া যায়।

• তাঁরা আর্থিক সুরক্ষাও দাবি করতে পারেন ছেলেদের কাছে।

• সেই সঙ্গে দাবি করতে পারেন বাসস্থান সংক্রান্ত সুবিধা। অর্থাৎ, মায়েরা ছেলেদের কাছ থেকে
থাকার জায়গা বা সেই সংক্রান্ত
খরচ চাইতে পারেন।

• মায়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে তাঁরা প্রোটেকশন অফিসারের নিরাপত্তায় থাকতে পারেন।

অর্থাৎ, এই আইনের মাধ্যমে একই সঙ্গে আর্থিক সুরাহা, মাথা গোঁজার ঠাঁই, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

ফৌজদারি কার্যবিধি

• বাবা-মা সন্তানদের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ নং ধারা অনুযায়ী খোরপোষ চাইতে পারেন।

• যে বাবা-মায়েরা নিজেদের প্রতিপালনে অক্ষম, আবেদন করতে পারেন তাঁরাই।

• দেখাতে হয় যে, বাবা-মাকে অবহেলা করছেন সন্তানেরা।

• এলাকার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হবে।

• খোরপোষ পাওয়ার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। সন্তানের রোজগার এবং বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর রেখে ম্যাজিস্ট্রেট খোরপোষের পরিমাণ ধার্য করবেন।

• এই ধরনের আবেদনে দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নজর রাখা হয়।

মুসলিম পার্সোনাল ল’

এই আইনেও সন্তানদের উপর তাঁদের বাবা-মায়ের দেখভাল করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

বসবাসের অধিকার

আপনি হয়তো সব সম্পত্তি ছেলে-মেয়েদের ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। কিংবা ছেলে আপনাকে চাপ দিয়ে বাড়ি লিখিয়ে নিতে চাইছে। অথবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতে যেতেই পারেন। তা ছাড়া এমন ঘটলে বারবার স্থানীয় থানার সাহায্য চান। স্থানীয় থানা হস্তক্ষেপ না-করলে, তখন কলকাতা হাইকোর্টে ‘রিট’ মামলা দায়ের করতে পারেন। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের দেখভাল না-করা শুধু সামাজিক মাপকাঠিতে খারাপ নয়, আইনের চোখেও তা অপরাধ।

মামলা করতে

বয়স্ক মানুষেরা যদি শারীরিক ভাবে অক্ষম হন এবং জীবনধারণের যথেষ্ট সঙ্গতি না-থাকে, তা হলে সন্তানের বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন কী ভাবে? এ ক্ষেত্রে জেলার তালুকের বা সাব ডিভিশনের আদালতে আইনি পরিষেবা কেন্দ্রের অফিস রয়েছে। সেখানে গিয়ে পরিষেবা পেতে আবেদন করা যায়। মহিলা তো বটেই, পুরুষ হলেও। নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নিখরচাতেই এর মাধ্যমে আইনি সুরাহা মিলতে পারে। মামলা দায়ের করা যেতে পারে নিখরচায়।

আইনের বাইরে

শেষে আইনের বাইরেও কয়েকটি কথা বলে রাখি। আইনজীবী হিসেবে নয়, একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কয়েকটি পরামর্শ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।

দেখুন, ছেলে-মেয়ে চাকরির জন্য বা বিয়ের পরে দূরে চলে গেলে বাবা-মা সমস্যায় পড়েন। বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে-কোনও এক জন আগে চলে গেলে যিনি থাকলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর দুশ্চিন্তা বিস্তর। শারীরিক অক্ষমতা, আর্থিক অনটন, চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যা, নিরাপত্তার অভাব— সব মিলিয়ে সমস্যার শেষ নেই। তাই আমার মতে—

• বয়স্করা পড়শিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। যাতে প্রয়োজনে তাঁরা এগিয়ে আসেন।

• পাড়ার ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলুন।

• স্থানীয় থানার ফোন নম্বর অবশ্যই সঙ্গে রাখুন।

• বাড়িতে কাজের লোক থাকলে, স্থানীয় থানায় পরিচারক/পরিচারিকার ছবি ঠিকানা-সহ পরিচয়পত্র দিয়ে রাখুন।

• বাড়িতে মিস্ত্রি লাগালে, তারও ছবি, নাম ঠিকানা ইত্যাদি কাছের ও পরিচিতজনদের জানিয়ে রাখুন।

আপনার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই কিন্তু এ সব জরুরি।

লেখক: কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী

(মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন