এক বছর হতে চলল পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু হয়েছে দেশে। কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা যেন আর ফুরোচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বহাল ধোঁয়াশাও। যে বিষয়গুলি সব থেকে বেশি ভাবাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম ফ্ল্যাট কেনা। একে তো এর জন্য ঢালতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। তার উপর অনেকেরই অভিযোগ, অনেক সময়ে প্রোমোটার আচমকাই জিএসটি দাবি করে বসছেন। বোঝার জো নেই সেই হিসেব কতটা ঠিক। যাঁরা গত জুলাইয়ে জিএসটি চালুর পরে ফ্ল্যাট কেনার পথে পা বাড়িয়েছেন, তাঁরা বুঝতে চান ওই করের অঙ্ক কত হওয়া উচিত। যাঁরা তার আগে ফ্ল্যাট বুক করেছেন, তাঁরা সম্ভবত আরও আতান্তরে। হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে অনেকের। সেই জট ছাড়াতেই আজকের আলোচনা।
পরিষেবার বদলে
ডেভেলপার বা নির্মাতা ফ্ল্যাট তৈরি করে দেন। জিএসটি আইন অনুযায়ী এটা এক ধরনের পরিষেবা। আর সেই পরিষেবা দেওয়ার জন্যই ওই ফ্ল্যাটের ক্রেতার কাছ থেকে জিএসটি আদায় করে তা সরকারের ঘরে জমা করার দায়িত্ব তাঁদের। তবে সঙ্গে অবশ্য ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুবিধাও পান। বলে রাখি, পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী যে পণ্য ও পরিষেবা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন, সেই খরচের উপর গোনা করের টাকা ফেরত মেলে। একে বলে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট।
করের হার
ফ্ল্যাটে জিএসটির হার ১৮%। কিন্তু ফ্ল্যাটের মোট দামের এক তৃতীয়াংশ জমির দাম হিসেবে গণ্য হয়। বাকি অঙ্কের উপরে ১৮% কর বসে। যা কার্যত মোট দামের উপরে ১২% কর বসার সামিল। এখানে সঙ্গের সারণিতে করের হিসেব সহজে বোঝানোর জন্য তাই ওই ভাবেই হিসেব করেছি আমরা।
তবে ফ্ল্যাট কিনলেই যে এই কর বইতে হবে, তা কিন্তু নয়। বিষয়টি নির্ভর করবে ফ্ল্যাটটি কী অবস্থায় কিনছেন তার উপর। অর্থাৎ, তা সম্পূর্ণ তৈরি না কি নির্মীয়মাণ?
যে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে
জিএসটি-র নিয়ম অনুযায়ী, নির্মাতা ফ্ল্যাটটি তৈরি করে ক্রেতাকে পরিষেবা দিচ্ছেন। তাই কর তখনই বসবে, যদি ফ্ল্যাটটি তৈরির আগে বা নির্মীয়মাণ অবস্থায় বুক করা হয়। কারণ, তখন বুক করা মানে, বিক্রেতার কাছ থেকে সেই পরিষেবা কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া। কর-সহ দাম মেটালে তবে ক্রেতা তা হাতে পাবেন। জায়গাটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি হলেও একই নিয়ম।
পুরোপুরি তৈরি
কেউ হয়তো পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাওয়া ফ্ল্যাট কিনলেন। পুরসভার কাছ থেকে যেটির কমপ্লিশন সার্টিফিকেট পাওয়া গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ক্রেতাকে এক পয়সাও জিএসটি দিতে হয় না। কারণ জিএসটি আইন অনুযায়ী তখন ফ্ল্যাটটিকে হাতবদলের জন্য তৈরি স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়। ক্রেতাকে নির্মাতা পণ্য বা পরিষেবা জোগান দিচ্ছেন— এই নিয়ম সে ক্ষেত্রে খাটে না। ফলে শুধু ফ্ল্যাটের যা দাম পড়ে, তা চুকিয়ে দিলেই হল।
সারণি শিক্ষা
সঙ্গের সারণির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে, তৈরি এবং নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটে করের ফারাক কতখানি। আমরা তো সাধারণত এই কারণেই নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকি যে, তাতে দাম কিছুটা কম পড়ে। কিন্তু আমার মনে হয়, জিএসটি জমানায় এসে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে করের অঙ্কও মাথায় রাখা ভাল। অর্থাৎ, নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাট কিনে লাভ তখনই, যদি জিএসটি মিটিয়েও তা একই ধরনের তৈরি ফ্ল্যাটের থেকে সস্তা হয়।
হারের ফারাক
দাম মেটানো হয়েছে জিএসটি চালুর আগে: ধরা যাক, কেউ জিএসটি চালুর আগেই নতুন ফ্ল্যাটের দাম আংশিক বা পুরোটা মিটিয়ে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে কোনও জিএসটি বসবে না। শুধু ৪.৫% পরিষেবা কর দিতে হবে।
কিছুটা মেটানো হয়েছে জিএসটি-র আগে, কিছুটা পরে: এ রকম ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের দামের যে অংশ জিএসটি চালু হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছে, তার উপর ক্রেতাকে পরিষেবা কর দিতে হবে। আর বাকি যে টাকা জিএসটি জমানা শুরুর পরে মেটানো হচ্ছে, তাতে ওই কর দিতে হবে।
হাতফেরতা বিক্রিতে
ফ্ল্যাট কেনার পরে সেটি যদি আবার বিক্রি করা হয়, তখনও কিন্তু জিএসটি বসবে না। যুক্তি ওই তৈরি ফ্ল্যাটের হাতবদলের মতোই।
ভর্তুকির আবাসন
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় গৃহঋণের সুদে ভর্তুকি গোনার প্রকল্প আনা হয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। এই ধরনের আবাসনের ক্ষেত্রে জিএসটি-র হার ৮%।
আর স্ট্যাম্প ডিউটি?
জিএসটি-র পাশাপাশি স্ট্যাম্প ডিউটিও দিতে হবে। আগের মতোই। রাজ্য সরকার বাজার দরের ভিত্তিতে স্ট্যাম্প ডিউটির যে হার স্থির করেছে, তা-ই দিতে হবে। সঙ্গে মেটাতে হবে রেজিস্ট্রেশন ফি। আগের মতোই। এ রাজ্যে এই বাবদ খরচ কেমন তা সঙ্গের সারণিতে দেওয়া হল। তবে রাজ্য ভেদে এই হার আলাদা।
করের তর্ক
আগেই বলেছি, নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাট কিনলে জিএসটি বসবে ১৮%। দামের এক তৃতীয়াংশ জমির মূল্য হিসেবে ছাড় পাবেন। যার হাত ধরে কর কার্যত ১৮% থেকে নেমে আসবে ১২ শতাংশে। অনেকের প্রশ্ন, ফ্ল্যাটের দাম কি তবে কমার কথা?
ডেভেলপারদের দাবি, পুরনো কর ব্যবস্থায় পরিষেবা কর নেওয়ার সময়ে ফ্ল্যাটের মোট দাম থেকে তার ৭০-৭৫ শতাংশ জমি ও উপকরণের দাম হিসেবে বাদ যেত। পরিষেবা কর গুনতে হত বাকিটুকুর উপরে। অর্থাৎ, ফ্ল্যাটের মোট দামের ২৫-৩০ শতাংশের উপর ১৫% হারে পরিষেবা কর গুনতে হতো। কিন্তু জিএসটি জমানায় পুরো টাকার উপরে ১২% কর গুনতে হবে। তাই ফ্ল্যাটের দাম বরং বাড়ার কথা বলছেন তাঁরা। কিন্তু আমার ধারণা, ফ্ল্যাট-বাড়ির দাম কমানোর জায়গা আছে। কারণ—
• আসলে জিএসটি গুনতে হচ্ছে ১৮% নয়, ১২%।
• সিমেন্ট, ইস্পাত, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ-সহ কাঁচামালে কর বাবদ গোনা টাকা ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট হিসেবে ফেরত পাবেন ডেভেলপার। পুরনো জমানায় যা পাওয়া যেত না। কাঁচামাল খাতের কর সমেত খরচ যোগ হতো ফ্ল্যাটের মোট খরচের সঙ্গে।
• গোড়ায় বাড়ি তৈরির বিভিন্ন উপাদান যেমন, সুইচ, পাম্প, মার্বেল, দরজা, জানলা, সব ধরনের কাচ, পাইপ বা পাইপ ফিটিংস ইত্যাদিতে জিএসটি বসেছিল ২৮%। কিন্তু পরে হয় ১৮%। গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, ফ্লাই অ্যাশের ইটে হার ১২% থেকে নামে ৫ শতাংশে। ফলে সুরাহা সেখানেও।
• পুরোপুরি তৈরি ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনা হলে, জিএসটি দিতেই হবে না।
• কেউ চুক্তির ভিত্তিতে (লেবার কনট্র্যাক্ট) সিঙ্গল ইউনিট অর্থাৎ বাড়ি (আবাসন বা ফ্ল্যাট নয়) তৈরি করলে, তাতেও জিএসটি বসবে না।
মনে থাকে যেন
জিএসটির নামে ক্রেতাকে ঠকালে, জিএসটি আইনের ১৭১ নম্বর ধারায় অ্যান্টি প্রফিটিয়ারিং কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হওয়া যায়। অভিযোগ প্রমাণ হলে পড়তে হবে শাস্তির মুখেও।
লেখক: কর বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)