গত দু’দফায় হাত গুটিয়ে রাখার পরে অবশেষে সুদ কমাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। মঙ্গলবার ঋণনীতি ফিরে দেখতে বসে রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমালেন শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। এর জেরে গাড়ি-বাড়ি ও শিল্প ঋণে সুদের বোঝা কিছুটা কমবে বলেই আশা সংশ্লিষ্ট মহলে। তবে সুদ আরও বেশি কমার প্রত্যাশা থাকায় হতাশ শেয়ার বাজারে সেনসেক্স পড়েছে ৫০০ পয়েন্টের বেশি। চাহিদা বাড়ার আশায় অবশ্য খুশি নির্মাণ শিল্প। তবে ঋণের মাসিক কিস্তিতে তেমন প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে না গাড়ি শিল্প।
বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ দেওয়ার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে-সুদ নেয়, সেই রেপো রেট এ বার কমে দাঁড়াল ৬.৫০%। তবে ঋণনীতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক দিকে যেমন ব্যাঙ্কের তহবিল সংগ্রহের খরচ কমানোর ব্যবস্থা করেছে, তেমনই অন্য দিকে ব্যাঙ্কগুলির হাতে যাতে নগদের জোগান বাড়ে, তার জন্যও নতুন কৌশল নিয়েছে।
তহবিল সংগ্রহের খরচ কমাতে রেপো রেট কমিয়েছেন রাজন। পাশাপাশি ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬% করেছেন রিভার্স রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ঋণ দিয়ে যে-সুদ পায়)। ফলে এখন থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ঋণ দিয়ে রিভার্স রেপো খাতে সুদ বাবদ বেশি আয় করার সুযোগ পাবে ব্যাঙ্কগুলি। তহবিল সংগ্রহের খরচ কমাতে মার্জিনাল স্ট্যান্ডিং ফেসিলিটির (এমএসএফ) আওতায় সুদের হারও কমানো হয়েছে। রেপো খাতে ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করার পরেও যদি ব্যাঙ্কগুলিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিতে হয়, তা হলে এমএসএফ খাতে তা মেলে। ওই বাড়তি ঋণে সুদও ৭.৭৫% থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৭%।
ব্যাঙ্কগুলিকে আমানতের যে-অংশ বাধ্যতামূলক ভাবে শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে জমা রাখতে হয়, সেই সিআরআর ৪ শতাংশেই অপরিবর্তিত থাকছে। কিন্তু সিআরআর খাতে দৈনিক জমার হার ৯৫% থেকে কমিয়ে ৯০% করা হয়েছে। প্রতিদিন ব্যাঙ্কগুলি যে-আমানত সংগ্রহ করে, তার ৪ শতাংশের ৯৫% রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে জমা দিতে হত ব্যাঙ্কগুলিকে। এখন ৯০% দিতে হবে। ফলে ব্যাঙ্কে নগদের জোগান বাড়বে।
এ বার নগদের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল বলে মনে করছেন ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞরাও। ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ বি কে দত্ত বলেন, ‘‘এক দিকে অনুৎপাদক সম্পদ খাতে ব্যাঙ্কের বিপুল টাকা আটকে রয়েছে। অন্য দিকে চলতি বছরেই মেয়াদ পূর্তি হওয়ায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকার বন্ড কেন্দ্রকে পুনঃক্রয় করতে হবে। ওই টাকার সংস্থান করতে সরকারকে ফের ঋণপত্র ছেড়ে বাজার থেকে ধার করতে হবে। সাধারণত ওই ধরণের ঋণপত্রের বড় অংশ ব্যাঙ্কগুলিকেই কিনতে হয়। যার জন্য প্রয়োজন হাতে নগদ টাকার।’’
এই ঋণনীতির পরে বাজারে সুদ কি কমবে? এ ব্যাপারে অবশ্য সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি ভাস্কর সেন এবং বি কে দত্ত উভয়েই বলেন, ‘‘সম্প্রতি এমসিএলআর বা বাড়তি তহবিল সংগ্রহের খরচের ভিত্তিতে ব্যাঙ্কের বেস রেট অধিকাংশ ব্যাঙ্কেই চালু হয়েছে। তার জেরে সুদ কমেছে। তাই এখনই চট করে ফের তারা সুদ কমাবে বলে মনে হয় না।’’ বন্ধন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর ঘোষও জানান, রাজন ঠিক পথেই এগিয়েছেন। কারণ নতুন ব্যবস্থায় এমনিতেই সুদ কমছে। এই নিয়ে গত এক বছরের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ১৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমিয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে সমান তালে ব্যাঙ্কগুলিকে সুদ কমাতে দেখা যায়নি বলে মূলধনী বাজার বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ।
তা ছাড়া ঋণে সুদ কমালে আমানতেও যদি তা কমাতে হয়, তা হলে ঝুঁকি আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ রেপো রেট কমানো-সহ যে-সব ব্যবস্থা শীর্ষ ব্যাঙ্ক নিয়েছে, তাতে স্বল্প মেয়াদে ব্যাঙ্কের তহবিল সংগ্রহের খরচ কমবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেওয়ার জন্য তাদের নির্ভর করতে হবে আমানতের উপরই। ‘‘তাই আমানতে ক্রমশ সুদ কমলে ব্যাঙ্কে টাকা রাখায় যাতে মানুষ উৎসাহ না-হারান, সে দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজর রাখা জরুরি,’’ বলেন ভাস্করবাবু।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমানোয় অবশ্য অখুশি শেয়ার বাজার। এ দিন সেনসেক্স পড়ে যায় ৫১৬.০৬ পয়েন্ট। দাঁড়ায় ২৪,৮৮৩.৫৯ অঙ্কে। ডলারে টাকার দামও কমেছে ২৫ পয়সা। এক ডলার হয়েছে ৬৬.৪৬ টাকা।
বাজার বিশেষজ্ঞ অজিত দে বলেন, ‘‘বিশেষত স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কমার ফলে বাজারের আশা ছিল এ বার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমাবে। কিন্তু সেটা না-হওয়ায় তারা আশাহত।’’ এ ছাড়া অন্যান্য দেশের শেয়ার বাজারগুলিও নেমেছে এ দিন। তারও বিরূপ প্রভাব ভারতে পড়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও শিল্পমহলও মনে করছে, ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমানোর এটাই উপযুক্ত সময় ছিল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পদক্ষেপে খুশি নির্মাণ শিল্পমহল। বিশেষজ্ঞ সংস্থা নাইট ফ্র্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার কর্তা শিশির বৈজল বলেন, ‘‘নির্মাণ শিল্প আপাতত খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে। এই সুদ ছাড়ের ফলে বাজার চাঙ্গা হবে।’’ একই সুরে নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই জানিয়েছে, সুদ কতটা কমবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে ব্যাঙ্কগুলির উপর। সুদে ছাড় ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছলে, আবাসন শিল্পের কিছুটা হাল ফিরবে। এ প্রসঙ্গে গৃহঋণ সংস্থা ডিএইচএফএলের সিএমডি কপিল ওয়াধওয়ান আশা করছেন, এর ফলে বাড়িঋণে সুদ কমবে।
তবে আবাসন শিল্পের মতো খুশি নয় গাড়ি শিল্প। তাদের আশা ছিল, আরবিআই আরও বেশি হারে সুদ কমাবে। গাড়ি শিল্পের সংগঠন সিয়াম-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সুগত সেন বলেন, ‘‘বাস্তবে ক্রেতার ইএমআইয়ে নগণ্য প্রভাব পড়বে। ফলে তাঁদের আগ্রহও বাড়বে না।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ব্যাঙ্কগুলি ক্রেতাদের কাছে সুদ কমার সুফল পুরোটা পৌঁছে দেয় না।