মুখে আশ্বাস, উদ্বেগ অন্দরে

মনমোহনকে আক্রমণ এখন বুমেরাং, ভরসা সেই রাজন-অস্ত্রেই

এ দিন ৩৩ পয়সা কমে দিনের শেষে মার্কিন মুদ্রা দাঁড়িয়েছে ৬৮.৪৬ টাকায়। মোদী সরকারের মন্ত্রী এবং শীর্ষ স্তরের আমলাও বড় মুখ করে দাবি করেছেন, টাকার এই পতনে কাঁপুনি ধরার কোনও কারণ নেই। সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মিলে পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নেবে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৮ ০৪:০০
Share:

বৃহস্পতিবার উদ্বেগের ৬৯ টাকায় উঠে যাওয়ার পরে শুক্রবার সেখান থেকে কিছুটা অন্তত নেমে এল ডলারের দর। এ দিন ৩৩ পয়সা কমে দিনের শেষে মার্কিন মুদ্রা দাঁড়িয়েছে ৬৮.৪৬ টাকায়। মোদী সরকারের মন্ত্রী এবং শীর্ষ স্তরের আমলাও বড় মুখ করে দাবি করেছেন, টাকার এই পতনে কাঁপুনি ধরার কোনও কারণ নেই। সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মিলে পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নেবে। কিন্তু সূত্রের খবর, আদতে কাঁপুনি ধরেছে দিল্লি দরবারের অন্দরে।

Advertisement

এই দুশ্চিন্তা ঠিক কতখানি, তা কিছুটা টের পাওয়া গেল আর্থিক বিষয়ক সচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গের কথায়। অর্থ মন্ত্রকের এই শীর্ষ স্তরের আমলা জানালেন, ‘‘বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে যথেষ্ট ডলার রয়েছে। তারপরেও বিদেশি লগ্নিতে টান পড়লে, বা বিদেশি মুদ্রার লেনদেনে ঘাটতি বাড়লে, আর এক দফা ফরেন কারেন্সি নন-রেসিডেন্ট ডিপোজিট চালু করা যায়।’’ যা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে তা হলে ফের রাজন-অস্ত্রেই ভরসা করার কথা বলতে হল কেন্দ্রকে।

২০১৩ সালেও ইউপিএ জমানায় ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম পড়ছিল হুড়মুড়িয়ে। আতঙ্ক ছড়িয়েছিল সরকার ও শিল্পমহলের মধ্যে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর এবং তার আগে অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব সামলানো রঘুরাম রাজনের দাওয়াই ছিল, ফরেন কারেন্সি নন-রেসিডেন্ট (এফসিএনআর) ডিপোজিট বা অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য ভারতীয় ব্যাঙ্কে ডলারে আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট চালু করার ব্যবস্থা। শেষমেশ বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে ডলারের পরিমাণ বাড়াতে তা কাজে দিয়েছিল। ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার সাপেক্ষে টাকার দাম।

Advertisement

অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এ দিন টাকার হাল ফেরাতে সেই রাজন দাওয়াইয়ে ভরসা করার কথা বলতে হল গর্গকে। সেই রাজন, মোদী সরকারের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় যিনি তিন বছর পরেই শীর্ষ ব্যাঙ্ক ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরের দু’বছরের বাড়তি মেয়াদের জন্য আর দৌড়েই থাকেননি। চলে যাওয়ার আগে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতো কিছু জনের কাছে ঠারেঠোরে তাঁকে শুনতে হয়েছে, ভারতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণা নাকি তাঁর ছিল না। সারাক্ষণ মার্কিন অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষাতেই নাকি মন ছিল রাজনের! ফলে ক্ষমতার অলিন্দেরই অনেকে বলছেন, বিপদে পড়ে এখন সেই রাজনেরই মন্ত্র জপতে হচ্ছে কেন্দ্রকে।

বুমেরাং হয়ে আসছে টাকার দাম তলানিতে যাওয়া নিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির দেওয়া খোঁচাও। গতকালই এ নিয়ে আক্রমণ শানিয়ে কংগ্রেসের কটাক্ষ ছিল, ইউপিএ জমানায় মনমোহন সিংহের বয়সের সঙ্গে ডলারের দামের তুলনা করে কটাক্ষ করতেন নরেন্দ্র মোদী। আর এখন তো প্রধানমন্ত্রীর বয়সকে (৬৪) তা ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও এ দিন বিঁধেছেন, ‘‘বিজেপি সেই অচ্ছে দিনের আশায় রয়েছে, য়খন এক ডলারের দাম দাঁড়াবে ৪০ টাকা।’’

ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের অবশ্য দাবি, টাকার দামের পতন নিয়ে কোনও চটজলদি প্রতিক্রিয়ার দরকার নেই। কারণ এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট মজবুত। রাজকোষ ঘাটতি, বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের ঘাটতির মতো মাপকাঠি নিয়েও চিন্তার কারণ নেই।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সেখানেও। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, শেষ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার সাড়ে সাত শতাংশ ছাড়ালেও গত অর্থবর্ষে তা ৭ শতাংশের নীচে। কৃষির হাল নিয়ে চাষিরা ক্ষুব্ধ। শিল্পে পুরোদস্তুর প্রাণ ফেরেনি এখনও। নতুন কল-কারখানা গড়তে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অঙ্ক নামমাত্র।

তার উপর চলতি আর্থিক বছরের প্রথম দু’মাসেই (এপ্রিল ও মে) রাজকোষ ঘাটতি সারা বছরের ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। ২০১৮-’১৯ সালে রাজকোষ ঘাটতিকে ৬.২৪ লক্ষ কোটি টাকায় বেঁধে রাখার লক্ষ্য রয়েছে। সেখানে সরকারি হিসেবই বলছে, মে মাসের শেষে ঘাটতি ৩.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের ঘাটতি ২.৫ শতাংশ। আগের বছরের থেকে অনেকটাই বেশি। ফলে প্রশ্ন, একে অর্থনীতির ‘অচ্ছে দিন’ বলা যায় কি?

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। এই মুহূর্তে ডলারের পাশাপাশি কেন্দ্রের মাথাব্যথা বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম ঘিরে অনিশ্চয়তা। ইরানের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হলে, যে সমস্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সঙ্গে তেল ও ডলারের দর বাড়তে থাকলে কিন্তু সমূহ বিপদ কেন্দ্রের।

গর্গের যুক্তি, ভারতের অস্ত্রাগারে যথেষ্ট গোলাবারুদ মজুত। গোলাবারুদ বলতে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। ২০১৩ সালের জুনের ২৯ হাজার কোটি ডলার থেকে এখন যা বেড়ে হয়েছে ৪১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।

কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভিজবে কি? উত্তর সময়ের গর্ভে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন