পুজোর মরসুমে আবহাওয়ার মতো শেয়ার বাজারও ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। অর্থনীতি নিয়ে নানা আশঙ্কা কখনওই স্বস্তি দেয়নি বাজারকে। অস্থির পরিস্থিতিতে লগ্নি গোটাতে শুরু করেছিল বিদেশিরা। ফলে সেনসেক্স ও নিফ্টি যথাক্রমে ৩২,০০০ এবং ১০,০০০-এর সীমা ছেড়ে নেমে আসার পরে এখনও সেই উচ্চতা ধরতে পারেনি।
আসলে জিএসটি রূপায়ণ নিয়ে বড় চাপের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি। উৎপাদন ধাক্কা খেয়েছে বিভিন্ন শিল্পে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার এপ্রিল থেকে জুনে ৫.৭ শতাংশে নেমে আসায় পুরো বছরে তা অনেকটা কমার আশঙ্কা করছে বিভিন্ন মহল। এই পরিস্থিতিতে ‘বেয়ার’-রা বাজারে নেমে পড়ে সূচককে টেনে-হিঁচড়ে নামাতে। এরা সাময়িক সাফল্য পেলেও পিএফ, এনপিএস, এসআইপি এবং অন্যান্য ইক্যুইটি ফান্ড থেকে একনাগাড়ে লগ্নির কারণে এরা কখনওই বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে পারেনি। বরং এই দুর্বল পরিস্থিতিতেও বাজারকে মাঝেমধ্যে উঠতে দেখা গিয়েছে।
একটু বড় মেয়াদে বাজার নিয়ে তেমন আশঙ্কা লগ্নিকারীদের মধ্যে নেই। এর কারণগুলি জানানো হল সঙ্গের সারণিতে। সব মিলিয়ে বাজারের বর্তমান দুর্বলতাকে সাময়িক বলেই মনে করা হচ্ছে। আশা, বছরের দ্বিতীয় অর্ধ থেকেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে অনেক শিল্পে। ফলে চাঙ্গা থাকবে শেয়ার বাজার।
চলতি সপ্তাহেই শুরু হয়ে যাবে ত্রৈমাসিক কোম্পানি ফলাফল প্রকাশের পালা। জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে অবশ্য খুব একটা ভাল ফলাফল আশা করা হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, জুলাই থেকেই শুরু হয়েছে জিএসটি রূপায়ণ।
সামনে ধনতেরস। এরই মধ্যে পাকা সোনা ছুঁয়েছে ৩০ হাজার টাকা (প্রতি ১০ গ্রামে)। সমস্যা হল, এই উঁচু বাজারেই মানুষ হুড়মুড়িয়ে সোনা কেনেন। সোনায় লগ্নি করুন আর না-ই করুন, প্রতি ধনতেরসে একটি করে এসআইপি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারলে হয়তো বেশি ভাল হবে। গত দু’তিন বছরে সোনায় লগ্নি আদৌ তেমন লাভজনক হয়নি। সম্পত্তিতে লগ্নির অবস্থা আরও খারাপ। এক দিকে ফ্ল্যাটের দাম বাড়েনি, বরং কমেছে কোনও কোনও অঞ্চলে। অন্য দিকে নিয়মিত গুনতে হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ এবং কর বাবদ খরচ। দু’বছর ধরে একনাগাড়ে নামছে ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার। বিকল্পের সন্ধানে বহু মানুষ পা বাড়িয়েছেন মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরাসরি ইকুইটি শেয়ারে লগ্নির পথে। গত দু’বছরে যখন অন্যান্য ক্ষেত্রের আকর্ষণ কমেছে, তখন এই দুটি ক্ষেত্র যথেষ্ট ভাল লাভের সন্ধান দিয়েছে। এ ছাড়া আছে কর বাবদ সুবিধা। পরিস্থিতি যা, তাতে আগামী দিনে আরও অনেক মানুষকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে সামিল হতে হবে ইকুইটির দুনিয়ায়।
বাজারে মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পের সংখ্যা এখন ২০০০-এর আশপাশে। প্রকল্পের সংখ্যা এত বেশি হওয়ায় লগ্নিকারীরা অনেক সময়েই বিভ্রান্ত হন। এই সমস্যা দূর করতে গত সপ্তাহে নির্দেশ জারি করেছে সেবি। বলা হয়েছে, এখন থেকে ফান্ড প্রকল্পগুলি বিভক্ত হবে পাঁচটি শ্রেণিতে। এগুলি হল ইকুইটি, ঋণপত্র বা ডেট, মিশ্র, নির্দিষ্ট লক্ষ্যের জন্য প্রকল্প (যেমন পেনশন ফান্ড) এবং অন্যান্য। প্রত্যেকটি শ্রেণিতে থাকতে পারে বিভিন্ন ভাগ বা উপ-শ্রেণি। যেমন, ইক্যুইটি ফান্ডের অধীনে থাকতে পারে ১০টি ভাগ: লার্জ ক্যাপ, মিড ক্যাপ, মাল্টি ক্যাপ, ই এল এস এস, ডিভিডেন্ড ইল্ড ইত্যাদি। একটি মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থা মাত্র একটি প্রকল্প রাখতে পারবে একটি উপ-শ্রেণিতে। এই নির্দেশ রূপায়ণে অনেক মিউচুয়াল ফান্ডকেই মেশাতে হবে একই শ্রেণির বিভিন্ন ফান্ডকে।
তবে গত দু’বছরে বাজার বেশ খানিকটা উঠলেও এটা সকলেরই জানা, ইকুইটিতে ঝুঁকি আছে। বিশেষত, বাজার যখন বিরাট উচ্চতায়। সেনসেক্স ও নিফ্টির অবস্থান যথাক্রমে ৩১,৮১৪ এবং ৯,৯৮০ অঙ্কে। এই দুই সূচকের দাম ও আয়ের অনুপাতও (পি ই রেশিও) এখন বেশ উঁচুতে। বাজার এতটা উঁচুতে ওঠার পিছনে যতটা না অর্থনৈতিক কারণ আছে, তার থেকে বেশি আছে অফুরন্ত টাকার জোগান এবং বিদেশি লগ্নি। যদিও দীর্ঘ মেয়াদে ভারতীয় অর্থনীতি বেশ ভাল জায়গায় থাকার কথা, তবুও আশঙ্কা, বিশ্ব বাজারে ছোটখাটো অঘটন সাময়িক ভাবে নাড়া দিতে পারে ভারতীয় বাজারকেও।
বাজার এতটা উচ্চতায় ওঠার পরে লাভ ঘরে তোলার তাগিদে ছোটখাটো সংশোধনের সম্ভাবনা সব সময়েই থাকবে। শেয়ার এবং ইকুইটি ফান্ডে যাঁরা লগ্নি করেন, তাঁরা এই ধরনের পতনের সঙ্গে পরিচিত। তবে প্রথম বার পা রাখার সময়ে বাজার উঁচু থাকলে অনেকেই পতনের কবলে পড়ে পিছু হঠেন। এঁদের পক্ষে কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডই তুলনায় ভাল লগ্নির জায়গা। তাঁরা ডায়নামিক ইকুইটি অথবা অ্যাসেট অ্যালোকেশন ফান্ড বেছে নিতে পারেন। এই সব প্রকল্প নিচু বাজারে ইকুইটি কেনে, চড়া বাজারে তার পরিমাণ কমিয়ে মূলত ঋণপত্রে টাকা ঢালে। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই কৌশলই ভাল।
পাশাপাশি, এ ভাবে লগ্নি খাতে ন্যূনতম আয়ও নিশ্চিত করা যায়। পতন ঠেকিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, সরাসরি লগ্নি করা যেতে পারে সে রকম ইকুইটিতেও। বেছে নিতে পারেন ভাল নতুন ইস্যু থেকেও। তবে ভাল মিউচুয়াল ফান্ড কিংবা ইকুইটিতে লগ্নি করার পরে কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখবেন, সবুরে মেওয়া ফলে।
রুপোলি রেখা
• জিএসটি রূপায়ণ সংক্রান্ত ধাক্কা আর কিছু দিনের মধ্যেই কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা। তার পরেই ভারতীয় অর্থনীতির ছন্দে ফেরা নিয়ে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
• অগস্টে ভারতের ৮টি মূল পরিকাঠামো শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশ। তা গত ৫ মাসে সর্বোচ্চ।
• আর্থিক বৃদ্ধির হার সাময়িক ভাবে কমলেও তা গোটা বিশ্বের এখনও বেশ উঁচু জায়গায়।
• সেপ্টেম্বরে যথেষ্ট ভাল হারে বেড়েছে গাড়ি বিক্রি। এই শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হাত ধরে অন্য অনেক শিল্পকেও চাঙ্গা করা যায়।
• সারা দেশে পর্যাপ্ত বর্ষার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, চাহিদা বাড়বে বহু পণ্যের। কমবে খাদ্যশস্যের দাম।
• এই দফায় ঋণনীতির পর্যালোচনায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ কমায়নি। তবে আশা, চলতি আর্থিক বছর শেষ হওয়ার আগেই আবার সুদ কমতে পারে।
• শিল্পে বেসরকারি লগ্নি আশানুরূপ না-হওয়ায় সরকারের তরফে বড় আকারের লগ্নির সিদ্ধান্ত। আশা বছরের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই উৎপাদন বাড়বে অনেক শিল্পে।
• সব মিলিয়ে শেয়ার বাজার চাঙ্গা থাকারই সম্ভাবনা।