পরিবেশ থমথমে। জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা থেকে বেরোচ্ছে পুলিশের গাড়ি। শুক্রবার। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।
জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানায় তোলাবাজি আর হুমকির অভিযোগ ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক নিয়ে ‘মুখ খুলল’ শিল্প। তাকে চিহ্নিত করল অবাঞ্ছিত এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হিসেবে। প্রত্যাশিত ভাবেই। কিন্তু সেই ‘নিন্দা’র বয়ানও এতটাই কূটনৈতিক যে, তা নতুন করে প্রশ্ন উস্কে দিল শিল্পমহলের অন্দরে। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি যে লগ্নির অনুকূল নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু রাজরোষের ভয়ে কি স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে এখানে? নইলে একের পর এক কারখানায় ঝাঁপ পড়ে যাওয়ার এমন আবহেও প্রতিবাদ আপাত মৃদু কেন?
শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানার ঘটনা সম্পর্কে শুক্রবার বণিকসভা সিআইআইয়ের বয়ান, “এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা জোরালো ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই ঘটনা কোনও ভাবেই কোনও রাজনৈতিক দলের, বিশেষত শাসক দলের ঘটানো নয়। এটা একান্ত ভাবেই কিছু সমাজবিরোধীর ব্যক্তিগত দুষ্কর্মের ফসল।” অন্য বণিকসভাগুলির বক্তব্যও তেমন ঝাঁঝালো নয়। যদিও এ নিয়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ক্ষোভ, হতাশা উগরে দিয়েছেন শিল্পপতিরা। চটকল কর্তাকে পিটিয়ে মারার ঘটনা থেকে জামুড়িয়া কাণ্ড সবই উঠে এসেছে সেখানে।
বিবৃতিকে নিখাদ কূটনৈতিক বয়ান হিসেবে পড়লে, সেখানে দেওয়া ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। ওই বক্তব্যে আদতে বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, শাসক দলের সদস্যদের হাতে এই হেনস্থা শিল্প তাড়ানো ছাড়া আর কোনও দিকে নিয়ে যাবে না রাজ্যকে। তাহলে কি আসলে তা-ই বলছে শিল্প? বিশেষত ভারতে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যেখানে রাজা আর আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা চলে না বলে মনে করে তারা। এই ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট ইন্ডিয়ান চেম্বারের বক্তব্যে। ডিরেক্টর জেনারেল রাজীব সিংহ বলেন, “এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি।”
কেউ কেউ বলছেন, এ রাজ্যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিল্প আসলে প্রাণপণ বিশ্বাস করতে চাইছে যে, শাসক দল এমন ঘটনাকে কোনও ভাবেই প্রশ্রয় দেবে না। এমন ক্ষেত্রে কখনওই অপরাধীর পাশে দাঁড়াবে না সরকার। আর পাহাড়প্রমাণ বাধার সামনে ওই বিশ্বাসটুকুই তাঁদের শেষ সম্বল। যে কারণে সিআইআইয়ের পশ্চিমবঙ্গ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান উমেশ চৌধুরী বলছেন, যে শাসক দল রাজ্যে শিল্পায়নের চাকা ঘোরাতে উদ্যোগী, তারা কখনওই সমর্থন করবে না এ ধরনের ঘটনাকে। এমসিসি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সঞ্জয় অগ্রবালের কথায়, শিল্পমন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রী-সহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের কাছে সহজেই পৌঁছনো যায়। এ ক্ষেত্রেও বিষয়টি জানালে আশা করি সমস্যা মিটবে।” সামগ্রিক ভাবেও শিল্প দাবি করছে, এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। অভিযোগ প্রমাণ হলে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিক রাজ্য। তবেই ধীরে ধীরে লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরত পাওয়ার কথা ভাবতে পারবে তারা।
কিন্তু এখানে আর একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে এ রাজ্যেরই শিল্পমহলের একটা বড় অংশের মনে। তাঁরা বলছেন, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, এ কথা তো শিল্প বিশ্বাস করতে চাইবেই। কিন্তু নিজেরা জমি কিনে খাড়া করা একটি প্রকল্পের উপর এ ভাবে আঘাত আসার পরেও কোনও কড়া প্রতিক্রিয়া নেই কেন? কেনই বা সামান্যতম কর্কশ সুরও বাজল না কোনও বণিকসভার বয়ানে? রাজরোষে পড়ার ভয়? না কি তারা মনে করছে কড়া প্রতিবাদ করলে আগামী দিনে আরও উটকো সমস্যা অপেক্ষা করবে তাদের জন্য?
লগ্নি টানতে এই সরকার নতুন ব্যবসা শুরুর হয়রানি কমানোর কথা বলে। দাবি করে সেই সংক্রান্ত নথি ৯৯ পাতা থেকে সাতে নামিয়ে আনার। এখানে শিল্পের কোর কমিটি রয়েছে। শিল্পের মন বুঝতে প্রকৃতির কোলে, জলের মধ্যে ইকো পার্কে গিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পপতিরাও প্রায়ই বলেন, চাইলে প্রশাসনের মাথাদের কাছে সরাসরি পৌঁছনো যায়। তাহলে এই সব কিছুর পরেও কেন প্রতিবাদে এমন চাণক্য-নীতি? ভিতরে গুমরেও উপরে মিষ্টির প্রলেপ রেখে দেওয়া?
এই প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠছে, কারণ, এ বার আঘাত এসেছে এমন কারখানার উপর, যারা সরকারের শর্ত মেনে নিজেরাই জমি কিনেছে। গোড়ার দিকে অনেক সমস্যা যুঝেও হাল ছাড়েনি। এখন টাকা ঢেলে কারখানা গড়ার পর যদি সেখানে তোলাবাজি ও অফিসারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, তা হলে তো ফের সামনে আসে রাজনৈতিক ঝুঁকির সেই পুরনো গল্প।
শিল্প কর্তারা বারেবারেই বলেন, রাজ্যে শিল্পের আজ এই দুরবস্থার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ঝুঁকি। শিল্প টাকা ঢালে সেখানেই, যেখানে সে মনে করে তার পুঁজি সুরক্ষিত। কারখানা নিরাপদ। হয়তো সেই কারণেই লগ্নির হাত ধরে লগ্নি আসে। আবার বিনিয়োগ রাজ্য ছাড়লে, তা-ও একই ভাবে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার হাত বাড়ায় অন্য বিনিয়োগের দিকে। তাই রাজ্যে লগ্নির টাকা যে সুরক্ষিত, সবার প্রথমে এই ধারণাটুকু তৈরি করতে পারা অসম্ভব জরুরি। দরকার রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানো। কিন্তু এ ভাবে কারখানার উপর ‘হামলা’ হলে, সেই ধারণা তৈরি হবে কী ভাবে?
হয়তো তাই ভারত চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকেশ শাহ বলেন, “বৃহস্পতিবার রফতানিকারীদের সংগঠন ফিও-র বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছেন শিল্পায়নের জন্য সরকারি উদ্যোগের কথা। কিন্তু বাস্তবে যদি তার প্রতিফলন না ঘটে, তা হলে লগ্নিকারীদের কাছে ভুল বার্তা যাবেই।” বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তর মতেও, লগ্নি টানতে রাজনৈতিক ঝুঁকি কমা জরুরি। অর্থাৎ, বয়ানে সাবধানী শিল্পও আসলে চাইছে এ বার কড়া হাতে শিল্পে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করুক রাজ্য। শ্যাম গোষ্ঠীর মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে। রাজা আর আগুনের সঙ্গে বিবাদ এড়িয়েই।