কোল ইন্ডিয়া, সেল, এনএইচপিসি, হিন্দুস্তান কপার থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ইউকো ব্যাঙ্ক, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও সরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে এ বার বাজারের হাতে থাকা মোট শেয়ারের পরিমাণ অন্তত ২৫% হতে চলেছে। তার কারণ, আজ বাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) নথিভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির শেয়ার মালিকানা নিয়ে এই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে ৭৫ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা রাখতে পারবে না। যে-সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কেন্দ্রের বাড়তি মালিকানা রয়েছে, তিন বছরের মধ্যে সেগুলির বিলগ্নিকরণ সেরে ফেলতে হবে।
এই সিদ্ধান্তের জেরে বাজারে নথিভুক্ত সংস্থার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে বৈষম্যের জমানায় ইতি টানল সেবি। এর ফলে নথিবদ্ধ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকেও বেসরকারি সংস্থার ধাঁচেই কমপক্ষে মোট ২৫% শেয়ার ছাড়তে হবে বাজারে। অর্থাৎ, সংস্থাটির রাশ যার হাতেই থাকুক না কেন, সকলের জন্য একই নিয়ম খাটবে। এত দিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে কমপক্ষে ১০% শেয়ার বাজারে ছাড়লেই চলত। সেবি চেয়ারম্যান ইউ কে সিংহ জানান, আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্র্ পদক্ষেপ।
প্রসঙ্গত, মারুতি উদ্যোগ, বালকো, ভিএসএনএল থেকে শুরু করে হিন্দুস্তান জিঙ্কের মতো একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ করে সাফল্য পেয়েছিল পূর্বতন বাজপেয়ী সরকার। বাজপেয়ীর প্রথম বিলগ্নিকরণ মন্ত্রী অরুণ জেটলি নরেন্দ্র মোদীর জমানায় অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ায় শেয়ার বাজারে আশা তৈরি হয়, এ বার বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নিকরণের পথে হাঁটবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ারের দামও বাড়তে থাকে। সেই আশাকেই আজ আরও উসকে দিয়েছে সেবি।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “সেবি-র নির্দেশ মেনে ৩৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ খাতে কেন্দ্রীয় কোষাগারে ৬০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে।” আরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বাজারে এলে যে-সব সাধারণ মানুষ বেশি ঝুঁকি না-নিয়ে শেয়ারে লগ্নি করতে চান, তাঁরাও আগ্রহী হবেন বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। বাজারে লগ্নিকারীদের মধ্যে এই অংশটা মাত্র ১%। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত শেয়ার বাজারে থাকলে আরও বেশি সাধারণ মানুষ শেয়ার বাজারমুখী হবেন। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, সেবি-ও সেই লক্ষ্য নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিজেপি নেতাদের একাংশ আবার বলছেন, বাজপেয়ী জমানায় বিলগ্নিকরণ মন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন বলেই জেটলি অর্থমন্ত্রী হিসেবে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ করে ফেলবেন, তা না-ও হতে পারে। কারণ নরেন্দ্র মোদী গুজরাতে বরাবরই রুগ্ণ সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণের বদলে সেগুলির দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য রাজ্য যখন বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বেসরকারি- করণ করেছে, তখন মোদী গুজরাতে ওই সংস্থাকে লাভজনক করে তোলেন।
সে কথা মাথায় রেখেই এয়ার ইন্ডিয়া ও কোল ইন্ডিয়া-র ক্ষেত্রে মোদী সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সে দিকে তাকিয়ে অর্থনীতিবিদ ও লগ্নিকারীরা। বহু বছর ধরে লাভের মুখ না-দেখায় এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। উল্টো দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা অনুযায়ী কয়লা জোগাতে ব্যর্থ কোল ইন্ডিয়া। মোদী সরকারের অন্দর মহলে অনেকেই মনে করছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ হলেও কোল ইন্ডিয়াকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে কয়লা উৎপাদন ও জোগানে দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা হতে পারে।
ইউপিএ জমানায় মন্দার জেরে শেয়ার বাজারেরও করুণ অবস্থা ছিল। ফলে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কোনও ক্ষেত্রে আবার বাজারে শেয়ার ছেড়েও ক্রেতা না-মেলায় অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দিয়ে তা কেনাতে হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্রের বক্তব্য, “জেটলি চলতি ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে বিলগ্নিকরণের ক্ষেত্রে ৩৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিতে পারেন। লোকসভা ভোটের আগে অন্তর্বর্তী বাজেটে বিদায়ী অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের রূপরেখাও তেমনই ছিল।” অপ্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা না-নিলেও জেটলি বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য পূরণে সফল হবেন বলেই অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের আশা।
পাশাপাশি, নতুন ইস্যুর বাজারকে চাঙ্গা করতে এবং সাধারণ লগ্নিকারীদের সুরক্ষিত রাখতে এ দিন আরও একগুচ্ছ ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছে সেবি।