গরিব মানুষের সঞ্চয় যাতে সারদার মতো বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সিন্দুকে গিয়ে জমা না-হয়, তার জন্য কিষাণ বিকাশ পত্র (কেভিপি) ফিরিয়ে আনল কেন্দ্র। এই একই লক্ষ্যে আগামী দিনে কেভিপি-র মতো আরও বেশ কিছু ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পও চালু করবে তারা।
মনমোহন সরকারের জমানায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কেভিপি যে ফের চালু করা হবে, তা বাজেটেই বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই অনুযায়ী আজ থেকেই তা নতুন করে চালু করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
এর উদ্দেশ্য তিনটি। এক, সারদার মতো সংস্থার হাত থেকে আগলে গরিব মানুষকে ডাকঘরের মতো নিরাপদ আশ্রয়ে টাকা জমানোর সুযোগ করে দেওয়া। দুই, টাকা জমানোর জন্য যাঁরা সোনা কিনতে পছন্দ করেন, তাঁদেরও সঞ্চয়ের বিকল্প রাস্তা দেখানো। তিন, বিশ্বজোড়া মন্দার পর দেশের অর্থনীতিতে কমে আসা সঞ্চয়ের হারকে ফের টেনে তোলা।
অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক আশা করছে, আগের বারের মতো এ বারেও কিষাণ বিকাশ পত্র জনপ্রিয় হবে। কারণ এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের টাকা ১০০ মাস বা ৮ বছর ৪ মাসে দ্বিগুণ হবে। সুদ মিলবে ৮.৭ শতাংশ হারে। যা ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে মেলা সর্বোচ্চ সুদের প্রায় সমান। জেটলির যুক্তি, গরিব মানুষকে বোকা বানিয়ে ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি তাঁদের টাকা আত্মসাৎ চালাচ্ছিল। কিষাণ বিকাশ পত্র চালু হওয়ায় তারা সরকারের ঘরেই নিশ্চিন্তে টাকা রাখতে পারবেন।
পশ্চিমবঙ্গে সারদার মতো সংস্থার বাড়বাড়ন্তের জন্য বামেদেরই দায়ী করে থাকে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের যুক্তি হল, বামফ্রন্টের আমলেই এই সংস্থাগুলি ফুলেফেঁপে উঠেছিল। বামেরা আবার কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে এর জন্য দায়ী করে এসেছে। তাদের বরাবরের যুক্তি, ডাকঘরে সঞ্চয় ক্রমশ আকর্ষণ হারানোর কারণেই দরিদ্ররা বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রেখেছেন। সেই সমস্যা মেটাতেই নতুন করে কিষাণ বিকাশ পত্র চালুর পাশাপাশি স্বল্প সঞ্চয়কারীদের জন্য আরও প্রকল্প চালু করা হবে।
অর্থ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব (বাজেট) রাজীব ভার্গব বলেন, “সরকার আরও কিছু প্রকল্প আনছে। স্বল্প সঞ্চয়ের টাকা উন্নয়নের কাজেই ব্যবহার হবে। এই ভাবে দেশের আর্থিক অগ্রগতিতে আমজনতাকেও আমরা সামিল করতে চাই।”
সঞ্চয়ে ভাল রিটার্নের জন্য যাঁরা সোনা কেনেন, এ বার তাঁরাও কিষাণ বিকাশ পত্রে আকৃষ্ট হবেন বলে অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের আশা। ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘরে সঞ্চয় বাড়লে সোনার চাহিদা কমবে। সাম্প্রতিক হিসেবে সোনা কেনার পরিমাণে চিনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ভারত। যার জেরে সোনা আমদানি করতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। যার ফলে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ার এবং ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থসচিব রাজীব মেহরিশি বলেন, “মানুষের কাছে সহজে সঞ্চয়ের তেমন কোনও রাস্তা ছিল না। তাই সোনা-রুপো কেনার উপরে ভরসা করতে হত।”
কিষাণ বিকাশ পত্রের অন্যতম বড় সুবিধা, এখানে সঞ্চয়ের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। কাজেই যে যত খুশি টাকা জমাতে পারেন। আজ জেটলি জানিয়েছেন, কিষাণ বিকাশ পত্রের শংসাপত্রে মালিকের নামও থাকবে না। কাজেই খুব সহজে তার মালিকানা হাতবদল হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের উপর কোনও আয়কর ছাড় পাওয়া যাবে না। তাই কালো টাকা সাদা করার জন্য কিষাণ বিকাশ পত্রকে কাজে লাগানো হতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন। মোদী সরকার ইতিমধ্যেই বিদেশের পাশাপাশি দেশেও কালো টাকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, লগ্নির উপর ঊর্ধ্বসীমা না থাকলেও ৫০ লক্ষ বা ১ কোটি টাকার বেশি কিষাণ বিকাশ পত্র কেনা হলে নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে। চাওয়া হবে সঞ্চয়কারীর পরিচয়পত্র এবং প্যান-কার্ড।
কিষাণ বিকাশ পত্রের হাত ধরে দেশের অর্থনীতিতে আগামী দিনে সঞ্চয়ের হারও বাড়বে বলে অর্থমন্ত্রীর আশা। বিশ্বজোড়া মন্দার প্রভাবে গত দু’তিন বছর ধরেই ভারতে সঞ্চয়ের হার কমেছে। এক সময় যে সঞ্চয়ের হার ৩৬ শতাংশের উপরে চলে গিয়েছিল, এখন সেটাই পিছলে গিয়ে পৌঁছেছে ৩০ শতাংশের নীচে। জেটলির বক্তব্য, “এই সঞ্চয়ের টাকা আর্থিক উন্নয়নে কাজে লাগে। কাজেই সাধারণ মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করাটা খুবই জরুরি।”