২০১৩ সালের ৮ অগস্ট। প্রস্তাবিত তালুক দেখতে এসে এলাকার মানচিত্রে চোখ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। এর পর বছর গড়িয়েছে। কিন্তু গোয়ালতোড় এখনও সেই তিমিরেই। —ফাইল চিত্র
সিঙ্গাপুরে লগ্নি টানার মঞ্চ হোক বা বণিকসভার অনুষ্ঠান। রাজ্যে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি থাকার দাবি হিসেবে গোয়ালতোড় শিল্পতালুকই মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান বিজ্ঞাপন। অথচ এখনও সেই তালুকের জমি তৈরির প্রাথমিক কাজে হাত দিতে পারেনি শিল্পোন্নয়ন নিগম। অভিযোগ, আজ পর্যন্ত সেখান -কার জমি তাদের হাতে তুলে দেয়নি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর। ফলে থমকে আছে কাজ। অথচ ওই দফতরের রাশ রয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে।
গত অগস্টে সিঙ্গাপুর সফরে গিয়ে সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের সামনে গোয়ালতোড় শিল্পতালুকের কথা উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দাবি করেন, রাজ্যে শিল্পের জন্য জমির অভাব নেই। শুধু জমি-ব্যাঙ্কেই রয়েছে তিন-চার হাজার একর। তার মধ্যে হাজার একর আছে গোয়ালতোড় তালুকেই। ওই জমির উল্লেখ করে তাঁর দাবি ছিল, সেখানে বড় কারখানা হতে পারে। উৎপাদন শিল্পের পক্ষে তা উপযুক্ত। আগে সিআইআইয়ের এক অনুষ্ঠানেও জমি সম্পর্কে আশ্বাস দিতে গিয়ে ওই তালুকের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, শিল্পমহলকে জমি নিয়ে আশ্বাস দিতে যে তালুকের কথা এত বার বলেন মুখ্যমন্ত্রী, তার জমি হস্তান্তরের কাজ এত দিন পড়ে রয়েছে কেন? কেনই বা তাকে ঘিরে এমন প্রশাসনিক গড়িমসি? বিশেষত যেখানে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীরই হাতে! যদিও এ নিয়ে দফতরকে প্রশ্ন করা হলেও কোনও উত্তর মেলেনি।
পশ্চিম মেদিনীপুরে গোয়ালতোড় শিল্পতালুক গড়ার পরিকল্পনা নতুন নয়। তা দানা বাঁধে বছর দুয়েক আগেই। কলকাতা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরে এই তালুক তৈরির জন্য কৃষি দফতরের প্রায় হাজার একর জমি চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু নিগমের অভিযোগ, সেই জমি এখনও তাদের হাতে আসেনি। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে একাধিক বার চিঠি লেখার পরেও এ বিষয়ে প্রশাসনিক ফাঁস কাটেনি। অথচ জমি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তার পরিকাঠামো তৈরির জন্য দরপত্র চাইতে পারছে না নিগম। ফলে এখনও পর্যন্ত হাত দেওয়া যায়নি জমির পরিকাঠামো তৈরির কাজে।
শিল্পমহলের মতে, কোথাও শুধু জমি পড়ে থাকলেই হবে না। শিল্প গড়তে টাকা ঢালার আগে সেখানে কিছু ন্যূনতম সুবিধাও দাবি করবেন লগ্নিকারী। চাইবেন বিদ্যুৎ, রাস্তার মতো অত্যাবশ্যক পরিকাঠামো। এখন শুধু জমি হস্তান্তরের কারণে ওই সমস্ত কাজ যদি এত দিন আটকে থাকে, তা হলে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি হতে তো অনেক দেরি। ফলে ততদিন লগ্নিকারীদের ওই জমি কী ভাবে দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে সন্দিহান তাঁরা। অবাক মুখ্যমন্ত্রীর নজরে থাকা শিল্প তালুকের জন্য জমি দিতে তাঁরই হাতে থাকা দফতরের এমন দেরি দেখে। বিশেষত যেখানে কিছু দিন আগেই ফিকি-র সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, শিল্পপতিরা চাইলে জমি ব্যাঙ্ক থেকেই জমি দেবেন তাঁরা। শিল্পমহলের প্রশ্ন, হাতে থাকা জমির পরিকাঠামো তৈরিতেই যদি এমন গড়িমসি হয়, তবে শুধু প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভিজবে কতখানি?
জমিতে ন্যূনতম পরিকাঠামো না থাকলে যে তা শিল্পের কাজে লাগে না, সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে গোয়ালতোড়েরই। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোকে সেখানে জমি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল রাজ্য। তখন পশ্চিমবঙ্গে ১,৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। এ জন্য ১,২০০ একর প্রয়োজন ছিল তাদের। কিন্তু পরিকাঠামো না-থাকায় গোয়ালতোড়ের জমি সংস্থা নেয়নি। ফলে ফিরে গিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার লগ্নিও। তাই তার পরেও রাজ্য যে জমি পরিকাঠামোহীন ভাবেই ফেলে রেখেছে, তা অবাক করছে অনেককে।
তবে শিল্পমহলের দাবি, সক্রিয় হলে, গোয়ালতোড় শিল্পতালুকে কেন্দ্রের সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে না রাজ্যের পক্ষে। কারণ, ইউপিএ জমানাতেই অমৃতসর-দিল্লি-কলকাতা শিল্প করিডর উন্নয়ন নিগম তৈরির প্রস্তাবে শিলমোহর পড়ে। প্রস্তাব ছিল যে, সেই নিগমের ৪৯% কেন্দ্রের হাতে থাকবে। বাকি ৫১% থাকবে ৭টি রাজ্য ও হাডকো-র হাতে। সেই পরিকল্পনায় প্রাথমিক ভাবে ওই করিডর ধরে সাতটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদন শিল্প তালুক গড়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গোয়ালতোড়ও। ফলে সেই সুযোগ কাজে লাগাতেও রাজ্য আদৌ পা বাড়াবে কি না, তা জানতে উৎসুক শিল্পমহল।