রাজ্যে লগ্নিতে বাধা সেই লাল ফিতের ফাঁস

সাত বছরেও জমি হাতে পায়নি রিলায়্যান্স রিটেল

লাল ফিতের ফাঁস আজও আলগা হয়নি। সাত বছর আগে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েও প্রায় সাড়ে আট একর জমির মালিকানা আজও পায়নি মুকেশ অম্বানির রিলায়্যান্স গোষ্ঠী । বিগত সরকারের আমলে ২০০৮ সালে রাজ্য সরকারের থেকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও বহরমপুরে জমি লিজে নেয় রিলায়্যান্স রিটেল।

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

লাল ফিতের ফাঁস আজও আলগা হয়নি। সাত বছর আগে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েও প্রায় সাড়ে আট একর জমির মালিকানা আজও পায়নি মুকেশ অম্বানির রিলায়্যান্স গোষ্ঠী ।

Advertisement

বিগত সরকারের আমলে ২০০৮ সালে রাজ্য সরকারের থেকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও বহরমপুরে জমি লিজে নেয় রিলায়্যান্স রিটেল। সাত বছর পরে সেই সাড়ে আট একর জমি এখনও হাতে পায়নি মুকেশ অম্বানির সংস্থা। তার মূলে রয়েছে জমির মালিকানা সংক্রান্ত জট। সরকার যে জমি ৯৯৯ বছরের জন্য লিজে দিয়েছে, সেই জমির উপর মাত্র ৩০ বছরের মালিকানা রয়েছে সরকারের। এই গোড়ায় গলদের জন্য বিগত বাম সরকারকেই দায়ী করেছে রিলায়্যান্স। কিন্তু তাদের আরও অভিযোগ বর্তমান সরকারও এই সমস্যা সমাধানে আগ্রহ দেখায়নি। সংস্থা সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে বর্তমান প্রশাসনকে একাধিক চিঠি লিখেও ফল হয়নি। সমস্যা সমাধান তো দূর অস্ত্। ভদ্রতার খাতিরে সামান্য জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন তারা মনে করেনি বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের উত্তরে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কেউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, এই জট ছাড়ানো কঠিন বিষয় নয়। রাজ্যপালের কাছে জমির লিজ স্বত্বের মেয়াদ বাড়ানোর আর্জি রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে। সাধারণত এ ধরনের আর্জি নাকচ হয় না বলেই দাবি বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরুই করেনি সরকার। ফলে জমি হাতে পাওয়ার জটিলতা থেকেই গিয়েছে। ফলে সাত বছর আগে জমির দাম মিটিয়ে দেওয়ার পরেও তা কাজে লাগাতে পারছে না রিলায়্যান্স। রাজ্য সরকারি সংস্থা নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন-এর থেকে শিলিগুড়িতে ২.৯৫ একর, জলপাইগুড়িতে ৪.৫ একর ও বহরমপুরে ১ একর জমি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিতে দরপত্র চায় তৎকালীন বাম সরকার। সবচেয়ে বেশি দর দিয়ে প্রতিটি জমির লিজ স্বত্ব পায় সংস্থা। শিলিগুড়ির জন্য সাড়ে সাত কোটি, জলপাইগুড়ির জন্য আড়াই কোটি ও বহরমপুরের জমির জন্য ২.১৫ কোটি টাকা দেয় রিলায়্যান্স রিটেল।

Advertisement

আর এই ঘটনাই ফের বুঝিয়ে দিল, গোটা দেশে সহজে ব্যবসা করার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ কেন প্রথম দশ রাজ্যের তালিকায় উঠে আসতে পারেনি। গত জুনেই কলকাতায় টাউন হলে রাজ্যের সব বণিকসভার সদস্য ও শিল্পপতিদের সঙ্গে ঘন্টা দেড়েকের বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচনার মূল বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করার প্রক্রিয়া সহজ করার পথে কতটা এগিয়েছে রাজ্য। এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০১১ সালে সহজে ব্যবসা করার মাপকাঠির বিচারে এ রাজ্যের স্থান ছিল সতেরো। অর্থাৎ সব রাজ্যের তালিকায় প্রায় শেষের দিকে।

এই ঘাটতির প্রসঙ্গ ধরেই রাজ্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। লগ্নিকারীদের সুবিধার জন্য জমির চরিত্র বদল, পরিবেশ, দমকল, বিদ্যুতের মতো ৩৮টি বিষয়ে এক-জানালা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এবং সব ক্ষেত্রেই সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

এ সব প্রতিশ্রুতি যে কথার কথাই থেকে গিয়েছে, তা নিয়ে শিল্পমহলের সংশয় নেই। এক শিল্প কর্তার খেদ, ‘‘খোদ রিলায়্যান্সের মতো গোষ্ঠীর এই হাল হলে, অন্য ছোট ও মাঝারি সংস্থার কী হবে, তা বলাই বাহুল্য।’’ প্রসঙ্গত ২০১৩ সালে মুম্বইয়ের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে শিল্প সম্মেলনের সাফল্য হিসেবে এ রাজ্যে ফোর-জি টেলিকম পরিষেবায় মুকেশ অম্বানী গোষ্ঠীর তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগই ছিল রাজ্য সরকারের তুরুপের তাস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে মুকেশ অম্বানী হাসছেন— রাজ্য সরকারের শিল্পায়নের প্রচেষ্টায় এই ছবিই প্রায় পোস্টার হয়ে উঠেছিল।

তবে এত কিছুর পরেও সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে নিতে তৎপর হয়নি প্রশাসন। রিলায়্যান্স রিটেল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সরকারি দফতরে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছেন। চিঠির পর চিঠি পাঠাচ্ছেন। প্রশাসনের তা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই বলেই ক্ষোভ সংস্থার।

শিল্পমহলের দাবি, এমনিতেই এ রাজ্যে লগ্নির বিষয়ে রিলায়্যান্সের পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এর আগে রাজনৈতিক বিরোধিতায় রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর লগ্নি পরিকল্পনা থেকে ছিটকে যায় পশ্চিমবঙ্গ। ২০০৬ সালে মুকেশ অম্বানী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে খুচরো ব্যবসায় তাঁর সংস্থা রিলায়্যান্স রিটেল প্রায় ২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সময়সীমা ছিল তিন বছর। বামফ্রন্টের শরিক দল ফরোয়ার্ড ব্লক রিলায়্যান্সের তীব্র বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক বাধায় ভেস্তে যায় সেই প্রকল্প। বিরোধিতা কেটে গেলেও সেই প্রকল্প আর আগের আয়তনে ঘুরে আসেনি এ রাজ্যে। তার কারণ সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে সংস্থার ব্যবসায়িক কৌশল ও পরিকল্পনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন