পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের এবড়োখেবড়ো হিরে কেটে, পালিশ করে তাকে চোখ ধাঁধানো করে তোলা। এবং তার পর তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি। এই কাজে দীর্ঘ দিন ধরেই বিশ্বে শীর্ষ স্থান ভারতের দখলে। কিন্তু এ বার সেই শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার দুশ্চিন্তাই পেয়ে বসেছে এ দেশকে। কারণ, পালিশ করা হিরে রফতানিতে ভারতের এই বেতাজ বাদশা ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে চিন। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যানে প্রকাশ, গত এক দশকে বিশ্বের পালিশ করা হিরের বাজারে চিন তাদের দখল প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে ১৭% করেছে। যেখানে ভারতের দখল এখনও ঘোরাফেরা করছে ১৯ থেকে ৩১ শতাংশে।
বিপদের আঁচ পেয়ে ইতিমধ্যেই পুরনো বন্ধু ও বিশ্বের বৃহত্তম অমসৃণ হিরে সরবরাহকারী রাশিয়ার হাত ধরতে উদ্যোগী হয়েছে ভারত। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরকালে সে দেশ থেকে হিরের জোগান নিশ্চিত করতে তাঁর কাছে দরবার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যাঁর নিজের রাজ্য গুজরাত এ দেশে হিরে পালিশ শিল্পের মূল আখড়া। বহু মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকা এই শিল্পকে আরও পোক্ত করতে রাশিয়ার খনিগুলি থেকে তোলা হিরে সরাসরি ভারতে আনার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন মোদী। এর জন্য প্রায় ডজনখানেক চুক্তিও সই করেন সে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত হিরে খনন সংস্থা আলরোসার সঙ্গে। কারণ, পালিশ করা হিরে রফতানিতে ভারতকে টেক্কা দেওয়ার পরিকল্পনায় এখন সরাসরি অমসৃণ হিরে আমদানিকেই হাতিয়ার করছে চিন।
প্রকৃতপক্ষে সারা পৃথিবীতে যত হিরে খনি থেকে তোলা হয়, তার বেশির ভাগটাই এত দিন আসত ভারতে। তার পর এখান থেকে কেটে ও পালিশ করে তা ফের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হত। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ভারতের ভরসা বেলজিয়ামের অ্যান্তোয়ার্প, ইজরায়েলের তেল আভিভ বা দুবাইয়ের মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হিরে কেনাবেচার হাবগুলির প্রতিনিধিরা। প্রধানত রাশিয়া ও আফ্রিকার খনিগুলি থেকে তোলা হিরে এরাই রফতানি করার আগে কাটা ও পালিশের জন্য ভারতে পাঠান। আর চিরাচরিত বাণিজ্যের এই চলতি পথ এড়িয়ে হিরে রফতানি বাড়াচ্ছে চিন। তারা সরাসরি আফ্রিকার খনি থেকে হিরে সংগ্রহ করছে। যেগুলিতে বিভিন্ন চিনা সংস্থার অংশীদারিও আছে। ফলে ভারতে সেগুলির জোগানে কোপ পড়ছে বলে মত বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সন্দীপ ভারিয়ার। তিনি জানান, এর ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে এখানকার বহু কারখানাকে। যার জেরে অনেক কর্মী ছাঁটাইও হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সরাসরি আমদানির এই অস্ত্র প্রয়োগ করেই পালিশ করা হিরে রফতানি গত পাঁচ বছরে ৭২% বাড়িয়ে ৮৯০ কোটি ডলারে নিয়ে গিয়েছে চিন। যেখানে ভারতের রফতানি ওই একই সময় বেড়েছে অনেক কম, ৪৯%। দাঁড়িয়েছে ১৪০০ কোটি ডলারে। আর রফতানি বৃদ্ধির এই হারই সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তবে অন্য এক অংশের মতে, চিনের সঙ্গে টেক্কা দিতে ভারতের আসলে প্রয়োজন আমদানি নীতি ও কর ব্যবস্থা আরও সরল করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হিরে কাটা ও পালিশের কাজে ভারত এখনও অনেক বেশি সংগঠিত ও দক্ষ। ফলে এখনই সিংহাসন হারানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে নিজের জায়গা ধরে রাখতে বিদেশি হিরে খননকারীদের কাছে এ দেশের হিরে পালিশ শিল্পকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা জরুরি। আর তার জন্য সবচেয়ে আগে শতাব্দী প্রাচীন কর-বিধি সংস্কার করার পক্ষেই সওয়াল করেন তাঁরা।