Coronavirus in Kolkata

করোনাজয়ীরা এখন শহর কলকাতার নব্য ব্রাহ্মণকুল, সুপার সিটিজেন্‌স

এঁরা কলকাতা শহরের নতুন এক শ্রেণির নাগরিক। নির্ভীক। অকুতোভয়। সুপার সিটিজেন্‌স! কারণ, এঁদের করোনা হয়ে সেরে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২০ ১২:৫৫
Share:

একবার করোনা হয়ে গেলেও শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি কতদিন সুরক্ষিত রাখবে নব্য ব্রাহ্মণকুলকে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

রসিকতা করে অনেকে প্রস্তাব দিচ্ছেন, এঁদের জন্য বিশেষ পাসপোর্ট চালু করা হোক। যা এঁদের বিনাবাধায় দোকানবাজার-সহ যত্রতত্র যাওয়ার ছাড়পত্র দেবে। অনেকে আবার বলছেন, এঁরা হলেন কলকাতা শহরের ‘নব্য ব্রাহ্মণকুল’। যাঁরা শরীরে করোনাজয়ের উপবীত ধারণ করেছেন।

Advertisement

এঁরা কলকাতা শহরের নতুন এক শ্রেণির নাগরিক। নির্ভীক। অকুতোভয়। সুপার সিটিজেন্‌স! কারণ, এঁদের করোনা হয়ে সেরে গিয়েছে। এবং একবার করোনাকে জয় করে ফেলার পর তাঁরা মনে অভয় পেয়েছেন। একা থাকলে অনেকে মাস্ক পরছেন না। ভাবছেন, শহরের সর্বত্র ঘুরে বেড়ানোর বিশেষ অধিকার আছে। এবং সেইমতো খোলা আকাশের তলায় বেরিয়ে পড়েছেন। কারও চিকিৎসক তাঁকে বলেছেন, শরীরের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে এখনই দ্বিতীয়বার আর করোনা সংক্রমণ হবে না। তিনি এখন ৩ মাস নিশ্চিন্ত। কারও চিকিৎসক সেই সময়সীমাকে বেঁধেছেন ২ মাসে। কারও চিকিৎসক আরও সাহসী। বলেছেন, ‘‘বেরিয়ে পড়ুন। এখন ৬ মাস কোনও চিন্তা নেই।’’

কিন্তু সঠিক সময়সীমাটাও তো কারও জানা নেই! একবার করোনা হয়ে গেলেও শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি কতদিন তাঁদের সুরক্ষিত রাখবে? কত সপ্তাহ? কত মাস? তার সঠিক দিশা কোনও করোনাজয়ী বা কোনও চিকিৎসকের কাছে নেই। তাই একটা উদ্বেগ এখনও সঙ্গী রয়েছে। তবু একটা অভয়, একটা ভরসা আছে বৈকি নব্য ব্রাহ্মণকুলের।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাজ্যে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী, আশা জাগিয়ে সামান্য বাড়ল সুস্থতার হার

যেমন রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু। বাংলার রাজনৈতিক ভিআইপি-দের মধ্যে তিনিই প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তা-ও লকডাউন জারি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। প্রথম কয়েকদিন বাড়িতে থাকলেও পরে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু তার পর থেকে এবং বিশেষত পুজোর সময় তিনি মাস্ক থুতনির তলায় কণ্ঠির মতো রেখে চুটিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরেছেন। এটা বিলক্ষণ জানা সত্ত্বেও যে, তাঁর দলনেত্রী তথা প্রশাসনিক নেত্রী করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি কঠোর ভাবে পালন করছেন। রবিবার, নবমীর সন্ধ্যায় তাঁকে যখন ফোনে ধরা হল, তখনও তিনি শ্রীভূমি ক্লাবে পারিষদ পরিবৃত। সটান বললেন, ‘‘বাইরে ঘুরতে তো হবেই। আমরা ঘরে বসে থাকলে কাজটা কারা করবে! অত ভয় পেলে কি চলবে?’’ তা হলে একবার করোনা হয়ে যাওয়ায় অভয় পেয়েছেন বলুন? জবাব এল, ‘‘একবার হয়ে যাওয়ায় খানিকটা অভয় তো পেয়েইছি। যাঁদের এখনও করোনা হয়নি, তাঁরা বরং বেশি ভয় পাবেন এখন। আমাদের আর ভয় কী?’’

​আরও পড়ুন: করোনার গ্রাসে পুজো, অপেক্ষা আগামী শারদীয়ার

বাংলার রাজনৈতিক ভিআইপি-দের মধ্যে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু। —ফাইল চিত্র।

যেমন ভয় পাচ্ছেন না শিল্পপতি সঞ্জয় বুধিয়া। অগস্ট মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেরে ওঠার পর ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরে গিয়েছেন। নিয়মিত অফিস করছেন। লোকজনের সঙ্গে দেখা করছেন। শুভানুধ্যায়ীরা ফোন করলে বলছেন, ‘‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, নাউ উই ক্যান মিট, গ্রিট অ্যান্ড ইট!’’ এখনও তাঁর মোবাইলের কলার টিউনে অমিতাভ বচ্চনের মন্দ্রস্বর বলছে, ‘‘কোভিড ১৯ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ইস লিয়ে যব তক দাওয়াই নহি, তব তক কোই ঢিলাই নহি।’’ অর্থাৎ। য়তক্ষণ না টিকা আসছে, ততক্ষণ গা-আলগা দেওয়া চলবে না। কিন্তু সঞ্জয় হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘এখন তো আমি করোনাজয়ী। কী করে হয়েছিল জানি না। কিন্তু এখন সেরে ওঠার পর নিয়মিত অফিস যাচ্ছি। লোকজনের সঙ্গে দেখাও করছি।’’ পাশাপাশি বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। মাস্কও ব্যবহার করছেন নিয়মিত। কিন্তু বুকের ওপর চেপে বসে-থাকা করোনার পাথর নেমে গিয়েছে।

এই করোনাজয়ীদের ঘনিষ্ঠরা জানেন, তাঁরা একটা সময় আশপাশের সুস্থ লোকজনকে ঈর্ষা করতেন। কারণ, সংক্রমিত হওয়ার পর তাঁদের বাধ্যতামূলক কোয়রান্টিনে থাকতে হয়েছিল অন্ততপক্ষে ২ সপ্তাহ করে। এখন অবশ্য চারপাশের লোকজন উল্টে তাঁদের দিকেই অসূয়ার চোখে তাকান। কারণ, সুজিত-সঞ্জয়রা এখন ‘স্বাধীন’। ভয়ে রয়েছেন বাকিরা। করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয় তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে অহর্নিশ। স্বাভাবিক। কারণ, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে রোজ বিদ্যুতের গতিতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। গত কয়েকদিনে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুও থেমে নেই।

একবার করোনা হয়ে গেলেও সমান সতর্কতা মেনে চলছেন রাজ চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।

সেই কারণেই কি ‘নব্য ব্রাহ্মণ’-দের একাংশ খানিক অস্বস্তিতে? পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘একবার করোনা হওয়ার পর সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে আমার ভাল লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। একা থাকলে আর মাস্ক পরি না। কিন্তু বাড়িতে বয়স্ক মা, শুভ (অভিনেত্রী স্ত্রী শুভশ্রী) আর ছেলের কথা ভেবে পরতেই হয়। ভাবি, আমার থেকে কারও যেন ক্ষতি না হয়। একবার করোনা হয়ে গেলেও সমান সতর্কতা মেনে চলি। আর সকলকেই বারবার বলি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরুন। কিন্তু সংক্রমণের কথা ভেবে নিয়ম মেনে চলুন।’’

অভিনেত্রী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়কে যেমন তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার ফলে ২ মাস করোনা তাঁকে আক্রমণ না-ও করতে পারে। কিন্তু দেবযানীর কথায়, ‘‘তখন মনে হয়েছিল, আর কিছু হবে না। কিন্তু এখন তো আবার ২ মাস পরেও সংক্রমিত হওয়ার খবর পাচ্ছি। ফলে একবার করোনা হয়ে গিয়েছে বলে আবার হবে না, এমন ধারনাটাই ভুল বলে মনে হচ্ছে। সেই ধারনা থেকে কেউ যদি মাক্স বা স্যানিটাইজার ছাড়াই ঘোরেন, তা হলে তিনি নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনছেন!’’ অভিনেতা তথা করোনাজয়ী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘একবার সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসকেরা এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, আর ভয় নেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, পরে আবার রোগটা ঘুরে আসবে কি না, তা বলা যায় না। রোগের গতিপ্রকৃতিটাই তো এখনও সঠিক ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তার মানে এটাও তো নয় যে, একবার সংক্রমণের পর সকলে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ছাড়া সকলে ঘোরাফেরা করবেন! আমি তো এখনও সমস্ত সতর্কতা মেনে চলছি।’’

অস্যার্থ— করোনাজয়ের উপবীত শরীরে ধারণ করেছেন বটে। তার জোরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও এসেছেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন, ‘ব্রহ্মতেজ’-এর সঙ্গে মাস্ক, স্যানিটাইজারও জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন