প্রতীকী ছবি
দুই ‘ভাই’-এর যৌথ আক্রমণ। আর সে কারণেই সংক্রমিতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দেশে। দেশে কোভিড ১৯-এর কতগুলি ‘ক্লেড’ (একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন গোষ্ঠী) রয়েছে, তার মধ্যে মারণ ক্ষমতা কতগুলির রয়েছে, সে সবের বিশ্লেষণে এমনই তথ্য উঠে এসেছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, দেশে কোভিডের আটটি গোষ্ঠী বা প্রশাখা রয়েছে। তাদের প্রতিটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (সিগনেচার) আলাদা। ক্রমাগত মিউটেশনের পরে তারা নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তবে ওই আটটির মধ্যে দু’টি গোষ্ঠীর কারণেই দেশে সর্বাধিক সংক্রমণ ঘটছে।
‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এর (আইসিএমআর) প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল নির্মল গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ভাইরাস যখন ছড়াতে থাকে, তখন তার মিউটেশন হতে থাকে। এই মিউটেশনের উপরে নির্ভর করেই কোনও গোষ্ঠী বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কোনওটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতে এই মুহূর্তে কোভিডের দুটো প্রধান মিউটেশনই ছড়াচ্ছে। ওই দুই গোষ্ঠীর যৌথ আক্রমণেই সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়ছে দেশে। মিউটেশনের চরিত্রের এই পার্থক্যেই কারও সংক্রমণ গুরুতর (সিভিয়র ইনফেকশেন) হচ্ছে, কেউ আবার উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত।’’
এমনিতে ভাইরাসের হাজার হাজার মিউটেশন হয় বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ক্রমাগত হয়ে চলা মিউটেশন যখন একটি বিশেষ রূপ নেয়, তখন একটি ‘ক্লেড’ তৈরি হয়। যার উপরে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের সংক্রামক ও মারণ ক্ষমতা নির্ভর করে। এক ভাইরোলজিস্টের কথায়, ‘‘যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রতি বার নিজেকে বদলাতে থাকে। সে কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে প্রতি বার ভ্যাকসিন পরিবর্তনের কথা বলা হয়। যে হেতু বছর বছর নতুন স্ট্রেন আসে।’’
এর আগেও সার্স কোভ-২-এর মিউটেশনের প্রসঙ্গটি একাধিক বার আলোচনায় উঠে এসেছে। যেখানে বার বার মিউটেশন হতে থাকলে ভাইরাসটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়বে, এমনটাও জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজ্ঞানীদেরই মত, দুর্বল যে হবেই, এমনটা বলা যাবে না। অন্তত সার্স কোভ ২-এর ক্ষেত্রে তো নয়ই। বেলেঘাটা আইডি-র এক সংক্রামক রোগ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সার্স কোভ-২ দুর্বল হয়ে পড়ার এখনও কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।’’
তবে শুধুমাত্রই ভাইরাসের ক্ষমতার উপরে নির্ভর করে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তেমনটা মানতে নারাজ অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, সংক্রমণের জন্য শুধু ভাইরাসই নয়, ‘হোস্ট রেসপন্স’-এরও (ভাইরাস যে দেহে প্রবেশ করছে, তার প্রতিক্রিয়া) সমান ভূমিকা রয়েছে। সার্স কোভ-২-এর ক্ষেত্রে যা বার বার দেখা যাচ্ছে। তাঁদের দাবি, এমন কোনও উদাহরণ এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি যে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। যাঁরাই মারা যাচ্ছেন হয় তাঁরা বয়স্ক, নয় কোমর্বিডিটি রয়েছে। অর্থাৎ যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই ‘কম্প্রোমাইজ়ড’। সার্স কোভ-২ সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অনুঘটকের কাজ করেছে।
এ ক্ষেত্রে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার (ইনেট ইমিউনিটি) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনিটি’ (কোনও প্যাথোজ়েনের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার পরে শরীরে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে) তৈরি হতে পাঁচ থেকে ছ’দিন সময় লাগে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত কোনও প্যাথোজ়েন কতটা কাবু করতে পারবে কাউকে, তা নির্ভর করে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরে। মাইক্রোবায়োলজিস্ট বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘‘একা ভাইরাস কিছুই করতে পারে না। তার জন্য হোস্টের প্রয়োজন হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, জেনেটিক গঠন-সহ একাধিক বিষয়ের উপরে নির্ভর করে সংক্রমণের ফলাফল। সেটাও কিন্তু কোভিড সংক্রমণের একটা উল্লেখযোগ্য দিক।’’