পুস্তক পরিচয় ১

তাঁর সৃষ্টি যাত্রাপথের প্রেরণাস্বরূপ

রবীন্দ্র-সার্ধশতবার্ষিক জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিল, রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার ও বাঙালি সমাজ তারই ফল। উনিশটি প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার নির্ণয় ও তার বিশ্লেষণ এই বহুদিকস্পর্শী গ্রন্থটির উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে।

Advertisement

অভীককুমার দে

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার ও বাঙালি সমাজ। সম্পাদনা: অভ্র ঘোষ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ৪০০.০০

রবীন্দ্র-সার্ধশতবার্ষিক জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিল, রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার ও বাঙালি সমাজ তারই ফল। উনিশটি প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার নির্ণয় ও তার বিশ্লেষণ এই বহুদিকস্পর্শী গ্রন্থটির উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে। সম্পাদক চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বঙ্গীয় উত্তরাধিকারের একটি সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করতে। চেষ্টা সত্ত্বেও এ কাজে সম্পূর্ণতা অর্জিত হওয়া কঠিন— সে কথা মনে রেখেই পাঠককে এই প্রয়াসসাধ্য সংকলনটির পরিচয় নিতে হবে।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বৈচিত্র বোঝার জন্য রবীন্দ্রসাহিত্য, সংগীতের বিশাল ভুবন, তাঁর শিক্ষাদর্শ ও তার প্রয়োগ, চিত্রকল্পনা, চলচ্চিত্র ভাবনা, বিজ্ঞানচর্চা, তাঁর দীর্ঘ জীবনে রাজনৈতিক চিন্তার দৃষ্টিকোণ, পরিবেশ পরিকল্পনা ইত্যাদি অনেকগুলি দিক এই প্রবন্ধ সংকলন স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রসঙ্গের উল্লেখই এই আলোচনার সীমিত পরিসরে সম্ভব।

রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ আছে: সন্‌জীদা খাতুনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশের গানের ভুবন’, অরুণকুমার বসুর ‘রবীন্দ্রসংগীতের সে কাল, এ কাল, অকাল’ এবং সুধীর চক্রবর্তী-র ‘রবীন্দ্রসংগীত ও তার পরবর্তী বাংলা গান’। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে অরুণকুমার বসুর বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ পেতে অভ্যস্ত আমরা আর সুধীর চক্রবর্তী এই বিষয়ে দীর্ঘদিন বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। তুলনায় বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও তত্ত্বজ্ঞ সন্‌জীদা খাতুনের প্রবন্ধ কম চোখে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর প্রবন্ধটিতে সে দেশে বারে বারে নানা শাসকের আমলে রবীন্দ্রচর্চা বা বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার ধারাটি যে বিভিন্ন অভিমুখে ধাবমান হয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তারই বিবরণ হাজির করেছেন। তাঁর লেখা জানাচ্ছে— ‘বাংলাদেশের সুদিনে-দুর্দিনে অনেক বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গানে আশ্বাস পেয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন, রবীন্দ্র-সংস্কৃতিকে অন্তরে লালন করেছেন। এঁরা বুঝেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেই বাঙালির ঐক্য, স্বাধিকার-বোধ এবং পরিণামে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ক্রমে বাস্তবায়িত হবে।... সংস্কৃতিসেবীদের জানা ছিল বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রবীন্দ্রনাথেই মূর্ত হয়ে রয়েছে। এই বিশ্বপথিকের পরিক্রমা শাশ্বত বাঙালি স্বভাবকে স্থির আশ্রয় করেই চলিষ্ণু ছিল। আর, রবীন্দ্রনাথ আপন সত্তায় বাঙালি সংস্কৃতি-সাধকদের যাবতীয় সম্পদ ধারণ করেছেন। রবীন্দ্র-অনুরাগীদের সকল কর্মে তাই কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়, সমগ্র বাঙালি ঐশ্বর্যের স্মরণ এবং সাধন।... বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিক অন্য দেশের রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভিন্ন। তিনি আমাদের সংস্কৃতি-পথযাত্রীদের আন্দোলনের সহযাত্রী। চিন্তানায়কশূন্য হতভাগ্য বাংলাদেশে কেবল রবীন্দ্রনাথের গান নয়, তাঁর কবিতা-প্রবন্ধ ইত্যাদি যাবতীয় সৃষ্টি সচেতন সকলের যাত্রাপথের প্রেরণা স্বরূপ।’

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনা নিয়ে পবিত্র সরকারের প্রবন্ধ সুদীর্ঘ (‘নারীর অধিকার ও রবীন্দ্রনাথ’) এবং সুতপা ভট্টাচার্য-র বিষয়ও নারী (‘রবীন্দ্রনাথ আর বাঙালি মেয়ে’)। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে ও বিচারে নারীর স্থান ও ব্যক্তি-নারীর অবস্থান নিয়ে সুতপা ভট্টাচার্য-র বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা সুপরিচিত। আমাদের সমাজে মেয়েদের স্থান ও তার ক্রমিক উত্তরণ নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ। তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে যে মেয়েদের পাই, একটি-দুটি বাদে তারা সকলেই বাঙালি মেয়ে। তবে তারা নিজেরা নিজেদের বাঙালি মেয়ে বলে পরিচয় দেয় না, দেওয়ার দরকার হয় না। কেননা, আখ্যানে তাদের নারীত্বই গুরুত্ব পায়, বাঙালিত্ব নয়।’ প্রবন্ধ শেষ করেছেন এই বলে, ‘সচরাচর রবীন্দ্রনাথ কবিতায় নির্বিশেষ নারীকেই দেখেছেন। তবে পুনশ্চ থেকে শুরু করে শেষ দশ বছরের কবিতায় বিশেষ নারীর দেখা মেলে। শ্যামলী কাব্যে সবচেয়ে বেশি। বাঙালি মেয়ের নানা ছবি এ বইয়ের নানা কবিতায় আঁকা আছে।’

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তা ও তার প্রয়োগের বিষয়টি বহু আলোচিত। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও। এই সংকলনে বিশ্বজিৎ রায় ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ: ইতিহাস, ভাবনা ও প্রয়োগ’ লেখাটিতে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, বিদ্যাসাগরের গোপালের জন্য রবীন্দ্রনাথের মাথাব্যথা নেই। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা পরিকল্পনা অশান্ত দুরন্ত সেই ছাত্রদের নিয়ে, যাদের মন বিচিত্র নূতন পথে আপনাদের সার্থকতা অন্বেষণের সম্ভাবনা বহন করছে। রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক পড়াশোনার দিকে ঝোঁক দিতে চাননি, বালক ও কিশোরদের ভিতরকার বহুমুখী সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রবন্ধকার কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্কুলের উল্লেখ করেছেন ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’। তা কিন্তু নয়, তাঁর প্রথম স্কুল ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’, প্রশান্তকুমার পাল সে তথ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতের আলোচনা মুখ্যত নির্ভর সেমন্তী ঘোষ-এর ‘একটি কাউন্টার পয়েন্ট: রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির শক্তি এবং সীমা’। এ গ্রন্থের মূল ভর এই প্রবন্ধ, এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না। বিপিনচন্দ্র পালের রবীন্দ্র-বিরোধিতার প্রসঙ্গ দিয়ে প্রবন্ধটির সূত্রপাত। বর্তমানে রবীন্দ্র-মানসের প্রাসঙ্গিকতার ছবি ফুটে উঠেছে প্রবন্ধটিতে, শেষ হয়েছে, ‘‘রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের ‘স্বদেশি সমাজ’ স্থায়ী হয়নি ঠিকই, কিন্তু স্থায়িত্বের প্রশ্নের মধ্যেই তার আসল প্রাসঙ্গিকতার শেষ নয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক এজেন্সি-র উপর ভিত্তি করে অতিক্রমণের রাজনীতির বাইরে বড়-দরের সাংগঠনিক রাজনীতিতে তাঁর উৎসাহ বা স্পৃহা ছিল না। কিন্তু ‘বড়’ সাংগঠনিক রাজনীতি যেহেতু প্রতিদিনের ‘ছোট’ সামাজিক ও ব্যক্তিগত অতিক্রমণের পথটাকে একেবারেই বাদ দিয়ে চলতে চায়, শুধুমাত্র প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতা সম্প্রসারণের বৃত্তেই চরকিপাক দেয়, তখন রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির কল্পিত ছবিটি, এবং সেই রাজনীতির দৃঢ়, আত্মসচেতন নৈতিক ভিত্তিটির মধ্যে একটা অন্য গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তার মধ্যে একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক ‘কাউন্টারপয়েন্ট’ দেখতে পাওয়া সম্ভব। রাজনীতিকে আজ আমরা যে ভাবে চিনছি ও জানছি, তাতে এই ‘কাউন্টারপয়েন্ট’টি ক্রমশই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।’’

এ দেশের সমাজে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের আলোচনা আছে, দু’টি প্রবন্ধ আছে, তারও প্রেক্ষিত এ দেশের সমাজগত যেমন, তেমনই রাজনীতিগত।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে পরিষৎ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংকলনের লেখকরা অধিকাংশই ছিলেন যুবা-বয়সি। সার্ধশতবর্ষে প্রকাশিত আলোচ্য এই সংকলনে যাঁদের প্রবন্ধ পেলাম, দু-তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের অধিকাংশই প্রবীণ ও সুপ্রবীণ। প্রশ্ন জাগে, বাঙালির রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার কি কেবলই প্রবীণরাই বহন করছেন? মুদ্রণ প্রমাদ যাকে বলে, তা চোখে পড়ল না। কিন্তু বইটিতে এত বানানের ভুল খুবই অপ্রত্যাশিত। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের মতো এই উপলক্ষেও পরিষৎ পত্রিকার আর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করলেই তো হত; গ্রন্থের খুব প্রয়োজন ছিল কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন