পুস্তক পরিচয় ১

দরজা খুলেই রেখেছিলেন

ম হাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আদিবাসী মানুষ। আদিবাসীদের নিয়ে বাংলা ভাষায় আগেও লেখা হয়েছে, কিন্তু এক জন লেখকের কলমে এতখানি লেখা আগে মেলেনি।

Advertisement

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

ম হাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আদিবাসী মানুষ। আদিবাসীদের নিয়ে বাংলা ভাষায় আগেও লেখা হয়েছে, কিন্তু এক জন লেখকের কলমে এতখানি লেখা আগে মেলেনি। তা ছাড়া, আগের লেখার কথা ও কথনরীতি মহাশ্বেতা দেবীতে অনেকখানি বদলে যায়। সে বদলের উৎস গত শতাব্দীর ষাটের দশকের নানা আন্দোলন, যার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল আদিবাসী অঞ্চল। মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী যোগের সূত্রপাত ওই সময়ে। তা নিবিড়তর হয় আট-দশ বছরে। তার প্রথম ফল ১৯৭৫-এ একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অরণ্যের অধিকার। সেই অধিকারের প্রশ্ন তারপর তাঁর লেখায় উচ্চারিত হতে থাকে নানা ভাবে এবং নানা প্রেক্ষিতে। ১৯৮২-তে প্রকাশিত হয় হুলমাহা ও শালগিরার ডাকে। অরণ্যের অধিকার-কে জুড়লে দেশের একটি বিস্তৃত অংশের আদিবাসী জীবনকথা ধরা থাকে ওই উপন্যাসত্রয়ীতে।

Advertisement

একই সময়ে অন্য এক ইতিহাসের সন্ধান করছিলেন সমাজ-অর্থনীতি-ইতিহাসের কিছু বিশিষ্টজন। তাঁরা প্রচলিত অধিপতি-সেনাপতি বৃত্ত ছেড়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসের রূপরেখা রচনা করতে চাইছিলেন। তার একটি পর্যায়ে, ১৯৮৮-তে, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রশ্ন তোলেন, ‘ক্যান দ্য সাবলটার্ন স্পিক’? কথাটির মধ্যে নানা রাজনৈতিক-সামাজিক মাত্রা ছিল। ইঙ্গিত ছিল নিম্নবর্গের কথা বলে যা শুনি তা সত্যিই তাদের কথা কি না। বিষয়টি জটিল, কারণ আদালতের বিক্রয়নামা যদিও বিক্রেতার নামে লেখা, কিন্তু তা দলিল-লেখকের ভাষা ও ভাষ্য সরকারি দস্তুরে। রাজনৈতিক দলিল দলের নামে লেখা হলেও তা দলনেতার কণ্ঠ। বিষয় ও বিষয়ী, লেখা ও লেখকের সম্পর্কের সত্যতাও নিম্নবর্গীয় তত্ত্বের সূত্র ধরে সাহিত্যপাঠে এসে পড়ে। সাহিত্যগত যে আলোচনা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে মহাশ্বেতা দেবী চলে আসতে থাকেন ভারত জুড়ে। তার বিস্তৃতি এক সময়ে বৃহত্তর জগতেও। নিছক ভক্তি নয়, জ্ঞান ও কর্মকে তিনি তাঁর আদিবাসী চর্চা ও চর্যায় যুক্ত করেন। নিজেকে বদলান এবং বদলের চালিকাশক্তিও হয়ে ওঠেন। তাই তাঁকে নিয়ে, তাঁর সৃজনকে নিয়ে নতুন নতুন পাঠ। সনাতন ভাওয়ালের দ্য সাবলটার্ন স্পিকস তেমনই একটি পাঠ সাম্প্রতিক সময়ে।

বইটির প্রথম আলোচ্য ‘ইতিহাসে নিম্নবর্গের কণ্ঠ’ এবং সে আলোচনা অরণ্যের অধিকার, হুলমাহা ও শালগিরার ডাকে উপন্যাস তিনটি নিয়ে। প্রথম উপন্যাসটিতে সারা উনিশ শতক জুড়ে মুন্ডাদের অরণ্যভূমি হারানোর ইতিহাস। শুরু আরও আগে, বিরসার ঠাকুরদার জন্মাবার কালে। ১৮৫৫ সালে ধানী মুন্ডা যোগ দেন সিদু-কানুর দলে মুন্ডাদের জমি রক্ষা করতে। তার চার দশক পরে বিরসা অরণ্যের অধিকার চান। সাঁওতালদের ‘হুল’ নয়, সর্দারদের ‘মুল্‌কই লড়াই’ নয়, তিনি ডাক দেন ‘উল্‌গুলান’-এর, এক মহাবিপ্লবের। তার বিরুদ্ধে একযোগে দাঁড়ায় দিখুদের দল, পুলিশ এবং চার্চও। ১৯০০-তে ধরা পড়েন বিরসা এবং ফাঁসি হয় কয়েক মাস পরে। কিন্তু মুন্ডাদের অবদমিত স্বরে ততদিনে অধিকারের ধ্বনি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে। তাঁদের গানে, গল্পে, নতুন উপমায় গাঁথাও হয়েছে এই ‘উল্‌গুলান’-এর কথা। মহাশ্বেতা দেবী এই বিকল্প ইতিহাসের মানুষজনকে খুঁজছিলেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। তাঁর নিজের অগ্নিময় সময় হয়তো তাঁকে খুঁজিয়ে নিচ্ছিল।

Advertisement

হুলমাহা-ও আর এক বিদ্রোহের ইতিহাস। জমিদার, মহাজন, নীলকুঠির সাহেব এবং কোম্পানি সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিল সেটা সাঁওতাল অভ্যুত্থান। বিস্তার পেয়েছিল দামিন, বীরভূম, ভাগলপুর, হাজারিবাগ, মানভূমের বিস্তৃত অঞ্চলে। বিদ্রোহের নায়ক কানু মুর্মুর ফাঁসি হয় ১৮৫৬-তে। মৃত্যুর আগে হুলমাহা-তে কানুর একটি কথা আছে— ‘আমি আবার আসব।’ ইতিহাসের অংশ হয়েও এই উচ্চারণ কিন্তু অতীত নয়।

শালগিরার ডাকে আরও খানিক পিছনের কাহিনি, ১৭৫০-এর। সেই বছরই জন্ম হয়েছিল তিলকা মুর্মু-র। তিলকার বয়স তখন পনেরো, কোম্পানির হাতে আসে বিহার-ওড়িশার ভার। তখন থেকেই তসিলদার-গোলদারদের শেকড়বাকড় ছড়ায় দূর-দূরান্তে। ১৭৭২-এ রাজস্ব আদায়ের শুরু এবং বিদ্রোহ নানা আদিবাসী অঞ্চলে। সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তিলকা মুর্মু। তারপর কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে নানান জায়গায় সংঘর্ষের পর আহত তিলকা বন্দি হন এবং তাঁর ফাঁসি হয় ১৭৮৫-তে। সনাতন তাঁর আলোচনায় দেখান, ঠাকুমার গল্পে এই পৃথিবীতে মানুষের জন্মবৃত্তান্ত শুনেছিলেন তিলকা। বাবার কথায় জেনেছিলেন সাঁওতাল জাতির ঐতিহ্য, সামাজিক বন্ধন এবং কৌমের মানুষজনের নৈকট্যের কথা। এই ইতিহাস তাঁর মধ্যে স্বপ্নের জন্ম দেয়। সে স্বপ্ন বাঁচার ও বাঁচানোর। তারই প্রতিষ্ঠা মহাশ্বেতা দেবীর এই উপন্যাসে। আবার তিলকা, কানু ও বিরসার তিন কাহিনির মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের ধারাবাহিকতাকে চিহ্নিত করেন মহাশ্বেতা দেবী। এই জঙ্গম ইতিহাসের বিপরীতে কোম্পানির নির্মিত ইতিহাস বেশ যান্ত্রিক— ফাঁসি, ফাঁসি এবং ফাঁসি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের বাঁচার ইতিহাসের পাশে শাসকের ফাঁসুড়ের ইতিহাস সাজিয়ে দিয়েছেন মহাশ্বেতা। আলোচ্য বইয়ে কোথাও তা ধরা থাকে।

চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর (১৯৮০) উপন্যাসটিকে নিম্নবর্গের নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহের স্বর বলে চিহ্নিত করেছেন আলোচক। চোট্টির পূর্বপুরুষ পূর্তি মুন্ডা যেখানে যেতেন, সেখানেই মাটি থেকে অভ্র বা কয়লা বেরত। এর ফলে তাঁকে নিয়ে ‘সমানে গল্প গজাত’। তাঁরই উত্তরপুরুষ হল চোট্টি, যে নামে একটি নদীও। সব সময়ে ওঁকে নিয়ে গল্প গজাচ্ছে। এও এক ইতিহাসের গড়ন, লিপি নিরপেক্ষ কথার কথা, যা মহাকথার জন্ম দেয়। নির্মিতির সঙ্গে যার যোগ আছে তা হল মহাকাব্যের, এমনকী চোট্টির তিরের সঙ্গে রাম বা অর্জুনের বাণেও মিল। তবে তার ব্যবহার চোট্টিতে গ্রিক মহাকাব্যের ঢালটির মতো। চোট্টি মুন্ডা কোনও বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন না, কিন্তু বিশ শতকের তৃতীয় থেকে সপ্তম দশক পর্যন্ত মুন্ডাদের কিছু তির ঠিক লক্ষ্যই ভেদ করে। সেই তিরের পিছনে চোট্টির কথা-মহাকথার যোগও থাকে।

অপারেশন? বসাই টুডু ষাট-সত্তরের কাহিনি এবং সনাতন এটিকে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক কণ্ঠ বলে চিহ্নিত করেছেন। বসাই কৃষক আন্দোলন করেছেন কালী সাঁতরার সঙ্গে, পরে মত ও পথ বদলান। বসাই অ্যাকশন-অপারেশনে চলে যান। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল না পাইপগানে, গুলিতে— বাবুদের অস্ত্রে। তাঁর বিশ্বাস তিরে। ইতিহাসের দ্বিধারার উৎস এখানেও। বসাই টুডু নকশাল আন্দোলনের একটি অঞ্চলের অ্যাকশনের নেতা হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁর জীবন ও মৃত্যু প্রচলিত রাজনৈতিক ইতিহাসের কাঠামোতে ধরা যায় না। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বসাই চার বার মরেন ও বাঁচেন। তাঁর বাঁচা-মরার থই পায় না পুলিশ, এমনকী বাম রাজনৈতিক দল দু’টিও। বসাই টুডুর সঙ্গে কালী সাঁতরার রাজনৈতিক দলবিভেদ ঘটে সত্তরেই, কিন্তু কালী সাঁতরার ডাক পড়ে বারে বারে বসাইকে চিহ্নিত করতে। দল বিভক্ত হলেও কালী ও বসাইয়ের বর্গে বোধ হয় তেমন পরিবর্তন ঘটে না। বসাইকে কালীর চেনা না-চেনা অন্য এক বর্গের অংশ। তা অনেক প্রাচীন, রাজনৈতিক দলগুলির জন্মের বহু আগের। এই চিহ্নিতকরণের জায়গাটি বইটিতে অন্য এক স্বরের সন্ধান দিয়েছে।

টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা-র পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৮৭-তে। সনাতন এটিকে চিহ্নিত করেছেন নিম্নবর্গের নীরব কণ্ঠ হিসেবে। যে আদিবাসীদের মূল স্রোতের চাপে বারে বারে দেশান্তরী হতে হয়, তাকে ভিটেমাটির সঙ্গে মৃতজনের সমাধিক্ষেত্র থেকে আপন সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারাতে হয়। রাজা থেকে প্রজা, প্রজা থেকে দাস, অঋণী থেকে ঋণবদ্ধ, তারপর হরোয়াহি মাহিদার হালি কামিয়া হয়ে ধুলোর মতো উড়ে যাওয়া। পিরথার আদিবাসীও অন্নহীন জলহীন ক্ষইতে থাকে ও মরে, জনসংখ্যা কমে। তখনই আকাশে উড়ে যায় পূর্বপুরুষদের আত্মা— পাখির রূপে। টেরোড্যাকটিলের প্রতীকে আদিবাসীদের অসহায় বিলুপ্তির সংকেত এখানে। নিম্নবর্গের মানুষের কথা হারানোর বৃত্তান্ত।

আরও দু’টি স্বরের কথা আলোচনা করেছেন সনাতন। এর একটি হল নারীকণ্ঠ, অন্যটি অপেক্ষাকৃত স্তিমিত কণ্ঠ। প্রথম অংশে আসে দ্রৌপদী, হুলমাহার মা, শনিচরী ইত্যাদি এবং দ্বিতীয়টিতে সাগোয়ানা ও অন্যান্য লেখা। আদিবাসী নারীদের নানা ভাবে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, ব্যবহৃত হওয়ার কাহিনি মহাশ্বেতা দেবীতে। এঁদের অনেককে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, এদের কথা শুনেছেন, নিজের নারী সত্তা দিয়ে অনুভব করেছেন। দিখু, ইটভাটার মালিক, সশস্ত্র বাহিনী, এদের লুণ্ঠন করে। ডাইনি অপবাদেও মারে। তবু কেউ কেউ উঠে দাঁড়ায়। সেনানায়কের সামনে দাঁড়িয়ে ধর্ষিতা নারী এনকাউন্টারের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। ক্ষীণ স্বর তখন ঘন ধ্বনিকে অস্বীকার করে। এ ভাবেই শালগাছ প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সেগুন বৃক্ষের।

সনাতন বিনির্মাণ তত্ত্ব, নিম্নবর্গের পাঠক্রম ইত্যাদির সঙ্গে ফরাসি দার্শনিক আল্যাঁ বাদিয়ুর চিন্তাকে তাঁর পাঠে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাদিয়ুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর মেলেও অনেক জায়গায় এবং সে কারণে দর্শনের সূত্র দিয়ে সৃজনের গুরুত্ব বোঝা। অনেক জায়গায় মিলেছে ঠিকই, কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে কষ্টকল্পিত মনে হয়েছে। সৃজন থেকে তত্ত্বগঠন আর তত্ত্ব দিয়ে সৃজন বোঝার মধ্যে উপার্জন ভিন্ন। কিন্তু সনাতন ভাওয়াল যত্ন ও সততার সঙ্গে বইটি লিখেছেন। সঙ্গে এটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের কাছে শুধু যাননি, তাদের জন্য দরজাও খুলে রেখেছেন। দরজা বন্ধ থাকলে লেখার সময় নিজের কথা নিম্নবর্গের নামে ঢুকে পড়ে। এমন কত গল্প-উপন্যাসই না লেখা হয়েছে বিগত চার-পাঁচ দশকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন