পুস্তক পরিচয় ১

ভারতশিল্পের বহুমাত্রিক রূপ

বছরখানেক আগে অধ্যাপক অশোক ভট্টাচার্যের আকস্মিক জীবনাবসান ঘটেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের শিল্প-ইতিহাস চর্চা হারিয়েছে এক অগ্রগণ্য ব্যাখ্যাতাকে।

Advertisement

গৌতম সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

উৎকর্ষ: কোনারকের সূর্যমন্দির। একই সঙ্গে মহৎ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রদর্শশালা

ভারতের ভাস্কর্য

Advertisement

লেখক: অশোক ভট্টাচার্য

১২০০.০০

Advertisement

পারুল বই

বছরখানেক আগে অধ্যাপক অশোক ভট্টাচার্যের আকস্মিক জীবনাবসান ঘটেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের শিল্প-ইতিহাস চর্চা হারিয়েছে এক অগ্রগণ্য ব্যাখ্যাতাকে। গত পাঁচ দশক জুড়ে অধ্যাপক ভট্টাচার্য নিরলস ভাবে শিল্প-ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বিষয়ে প্রকাশ করেছেন অনেক ক’টি প্রবন্ধ এবং বই। তাঁর চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে; সংস্কৃত শিল্পশাস্ত্র অবলম্বনে প্রাচীন চিত্রশিল্পের করণকৌশল, বিভিন্ন রঙের যথার্থ পরিচয়, শিল্পীর অভিপ্রায়কে অনুভব করা থেকে গুহাচিত্রের উজ্জ্বল জগৎ, অণুচিত্রের ব্যঞ্জনা, ধাতুমূর্তির কালক্রম ও শৈলীগত বিশিষ্টতা থেকে শিল্প-ইতিহাসকারদের জীবন ও কৃতি এবং আধুনিক এবং সমকালীন ভারতীয় চিত্রকলার বিচিত্র অভিমুখ— শিল্প-ইতিহাসের একাধিক পর্বে ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

অশোক ভট্টাচার্যের আলোচ্য বইটি শিল্পরসিকদের জন্য রসবেত্তার রচনা। এটি লেখকের সর্বশেষ কাজ— ভারতবর্ষের কয়েক সহস্রাব্দ পরিব্যাপ্ত ভাস্কর্য পরম্পরার সিংহাবলোকন। কাহিনি সাজানো হয়েছে পরিচিত সময়ক্রম অনুসরণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের মতোই ভাস্কর্যের কাহিনিও বহুমাত্রিক। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে গ্রামসমাজে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ সহস্রাব্দে আদিমতা-চিহ্নিত মাতৃকারূপ গড়া হয় পোড়ামাটিতে, সেখান থেকে প্রাগ্রসর হরপ্পার নাগরিক সভ্যতায় পাথর এবং ধাতুমূর্তিতে; সংখ্যায় অল্প, তার প্রকাশ ভিন্নমুখী। কেনই বা হরপ্পা সভ্যতার দীর্ঘ জীবনে ভাস্কর্যের স্বল্পতা? নাগরিক রুচি কি উদাসীন ছিল পাথর বা ধাতুর অপরিসীম সম্ভাবনার প্রতি? এ কি প্রযুক্তিগত সমস্যা? প্রশ্ন অনেক, উত্তর প্রায় অজ্ঞাত। হরপ্পা সভ্যতার পর দীর্ঘদিনের শূন্যতা। হঠাৎই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতাব্দীতে নেপাল তরাই থেকে, গঙ্গাযমুনাবিধৌত সমভূমি ছাড়িয়ে, মধ্যভারতে একশিলা স্তম্ভ এবং স্তম্ভশীর্ষে পশুমূর্তির উদ্ভব। এই বিপুলায়তন ভাস্কর্যের ধারণা এবং কৃৎকৌশলের উৎস কী? অধ্যাপক ভট্টাচার্যের মত, আয়োনিয়া থেকে প্রাচীন পারস্যের পথ ধরে শিল্পীদের চংক্রমণ ঘটেছিল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। তাঁরাই এই পরিবর্তনের নায়ক।

মৌর্যোত্তর পর্বে কাহিনির গতিপথ বদল। মৌর্য পর্বের ত্রিমাত্রিক বিপুলায়তন ভাস্কর্যের পরম্পরাকে বর্জন করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পীরা বেছে নিলেন দ্বিমাত্রিক রিলিফধর্মী ভাস্কর্যের রূপ, যার বিষয়বস্তুতে লৌকিক এবং অলৌকিক কাহিনির উপস্থাপনা। শিল্পীরা যেন কাঠের কাজ পাথরে অনুবাদ করছেন— উপর থেকে নীচে এবং পাশাপাশি কাহিনির বিস্তারে পটচিত্রের ভাষার প্রয়োগ। পরিবর্তিত রাষ্ট্রকাঠামো এবং ভাবাদর্শে শিল্পীরা কি স্বচ্ছন্দ ছিলেন আবহমানের লোকায়ত শিল্পভাষায়? আবার এক ঝাঁক প্রশ্ন এবং তা অনুধাবনের প্রয়াস। মধ্যপ্রদেশের ভারহুত, সাঁচি, বিহারের বুদ্ধগয়া কিংবা ওডিশার উদয়গিরি-খণ্ডগিরিতে যা ঘটছে, তার আরও পরিশীলিত রূপ দেখা যাবে কৃষ্ণা নদীর আশপাশে। এখানেও বৌদ্ধধর্ম এবং বণিক-শিল্পী-কারিগরদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। অমরাবতী, নাগার্জুনকোণ্ডা থেকে কনগনহল্লিতে কাহিনিধর্মী ভাস্কর্যের বিষয়গত এবং রূপগত বিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। কত আপাত অজ্ঞাত বা স্বল্পজ্ঞাত উপাদান থেকে পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পীরা কথা-কাহিনি চয়ন করেছেন, তা ভাবলে বিস্ময় লাগে। অধ্যাপক ভট্টাচার্য পরম মমতা এবং ঈর্ষণীয় সংবেদনশীলতায় পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাত্রার কথা লিখেছেন।

এই পর্বে এবং তার একটু পরে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় যে পরীক্ষানিরীক্ষা চলে, তাও তো অতুলনীয়। কঠিন গ্র্যানাইট শিলা কেটে কৃত্রিম গুহা— বৌদ্ধ সাধুদের আবাস। জল ধরে রাখার পাত্রের পাশাপাশি বড় মাপের প্রায় ত্রিমাত্রিক মূর্তি এবং রিলিফধর্মী ভাস্কর্য— সব মিলিয়ে বিপুল কর্মকাণ্ড। প্রাক্‌-খ্রিস্টশতকের অন্তিম পর্বে এবং খ্রিস্টশতকের প্রথম পর্যায়ে সাতবাহন-কুষাণ রাজত্বকালে ভাস্কর্যের পথ বহুমুখী। কখনও রোমক এবং মধ্য এশিয়ার প্রভাবে রাজপ্রতিকৃতি, কখনও ভক্তির নব-উদ্গমে বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব প্রতিমা, জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি-লাঞ্ছিত আয়োগপট্ট, এবং ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী।

মথুরা নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাস্কর্যশৈলী— যা পরবর্তী পর্বের ভারতীয় ভাস্কর্যের মৌল লক্ষ্মণগুলি চিনিয়ে দেবে। অন্য দিকে উত্তর-পশ্চিমে গন্ধার শৈলী— যার বিষয়বস্তু ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম কিন্তু শৈলী নিশ্চিত ভাবে রোমান ধারা থেকে আহরিত। নাগরিক মানসিকতা ধরা আছে মথুরার নাগরিকাদের বিচিত্র বিভঙ্গের রূপায়ণে। এই পর্যায়েই ভারতের ভাস্কর্যের রূপভাবনা একই সঙ্গে পার্থিব এবং পরিশীলিত হয়ে ওঠে। অনেক ক’টি উৎকৃষ্ট নিদর্শনের প্রতিলিপিসহ অধ্যাপক ভট্টাচার্য এই জটিল বর্ণময় জগৎকে তুলে ধরেছেন।

ভারী, পৃথিবীর টানে বাঁধা কুষাণ শৈলী থেকে প্রায় অপার্থিব, বাহুল্যবর্জিত সুঠাম অবয়ব, নিরাভরণ, নিরলংকার বুদ্ধমূর্তিতে উত্তরণ সর্বার্থেই যুগান্তকারী ঘটনা। সংস্কৃত সাহিত্যের ধ্রুপদী ধারার চরম উৎকর্ষ, দর্শন ও ধর্মভাবনার বিশিষ্ট রূপ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও দৈবশক্তির সফল মিশ্রণ— সব মিলিয়ে এক নতুন ভাবনার জগৎ, যেখানে আদর্শায়িত মানবরূপের আদলে নির্মিত হয় দেবপ্রতিমা। কখনও তা নিবাতনিষ্কম্প প্রদীপের মতো আত্মসমাহিত— সারনাথের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ, কখনও তা বীরত্বব্যঞ্জক এবং সম্রাটের দৈবীক্ষমতার প্রতীক যেমন উদয়গিরির বরাহ, কখনও তা পশ্চিম ভারতের মাতৃকাবৃন্দ যাদের ভাব, ভঙ্গি এবং আচ্ছাদনে ধরা পড়ে পশ্চিমি অভিঘাত।

গুপ্ত পর্ব থেকে আদি মধ্যযুগ (নবম থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টশতক)— ভাস্কর্যের ভূগোলের প্রসার সর্বব্যাপ্ত। বিষয়বৈচিত্রে, কৃৎকৌশলের বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, উপাদান নির্বাচনে শিল্পীসমাজ অসাধারণ সংবেদনশীলতা দেখিয়েছেন। গুপ্তোত্তর পর্বের ভাস্কর্যে, বিশেষত পাহাড় কুঁদে বানানো মূর্তিতে শিল্পীরা সরে এসেছেন ধীর, সৌম্য রূপ থেকে— ইলোরার রাবণানুগ্রহ মূর্তিতে গতির সঙ্গে স্থিতির প্রাণবন্ত সহাবস্থান। আদি মধ্যযুগে মন্দির নির্মাণে জোয়ার এসেছিল। আঞ্চলিক রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত জুড়ে নানা শৈলীতে মন্দির বানানো হয়, আর ভাস্কর্যের ব্যাপক ব্যবহার ঘটে মন্দিরসজ্জায়। ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো বা তাঞ্জোরের মন্দিরগুলি একই সঙ্গে মহৎ স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের প্রদর্শশালা। স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের এই অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ভাস্কর্যের চরিত্রেও বদল এনেছে। ভাস্কর্যে অলংকরণ বেড়েছে, ঝোঁক এসেছে দেহের ভাঁজ ভঙ্গ নিয়ে নানা পরীক্ষার। কোথাও কোথাও, যেমন কোনারকের বড় আকারের সুরসুন্দরী মূর্তিগুলি ত্রিমাত্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখে, যেন এক ব্যতিক্রমী ধারা। বাংলার একাদশ-দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্যে কিংবা প্রায় একই সময়ে কর্নাটকের হোয়সল মন্দিরে মূর্তির গড়ন এবং অলংকরণে ধাতুশিল্পের প্রভাব স্পষ্ট। পাথরের পাশাপাশি ধাতুমূর্তির প্রাণবন্ত পরম্পরাও সজীব থেকেছে। রঁদ্যা বন্দিত চোলযুগের ব্রোঞ্জ নটরাজে ধরা পড়েছে সৃষ্টি স্থিতি বিলয়ের ভাবরূপ।

অধ্যাপক ভট্টাচার্য এই বিচিত্র, বহুমুখী, সতত উদ্ভাবনশীল সৃষ্টিকর্মের কাহিনি পরিবেশন করেছেন ঋজু, নির্মেদ গদ্যে, নিটোল তথ্যবিন্যাসে এবং গভীর রসবোধে। সুমুদ্রিত বড় আকারের এই বইয়ে, আলোকচিত্রের প্রাচুর্য, বর্ণনাকে দৃষ্টিগোচর করে তোলে। বাংলা ভাষায় ভারতের ভাস্কর্যের এ এক প্রামাণিক গ্রন্থ। লেখকের সিদ্ধি তিনি পাঠকসমাজকে পৌঁছে দিয়েছেন শিল্পসৃষ্টির আনন্দ-বেদনাঘন সময়ের কাছাকাছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন