চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

কল্পরূপের যাত্রায় যখন অস্তিত্বের সংকট

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেনকলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে পাশ করে বেরিয়েছেন, এ রকম ৩৪ শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে প্রদর্শনী হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম : ‘আমরা নয়-ছয়’।

Advertisement

মৃণাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

শিল্পী: বেলি সরকার।

কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে পাশ করে বেরিয়েছেন, এ রকম ৩৪ শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে প্রদর্শনী হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম : ‘আমরা নয়-ছয়’। এই প্রদর্শনী আমাদের বুঝতে সাহায্য করে শিল্প-শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা শেষ করে বেরোনোর পর শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা অর্জনের পথটি খুবই কঠিন। এই আর্ট কলেজের একটি বৈশিষ্ট্য — এখানে স্বাভাবিকতাবাদী চিত্ররীতি ও ভারতীয় আঙ্গিকের শিক্ষাধারা পাশাপাশি চলে এসেছে দীর্ঘ দিন। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে। এই সম্মিলন থেকে রূপরীতি বিকশিত হয়েছে নানা ধারায়। এই বৈচিত্রের পরিচয় রয়েছে প্রদর্শনীতে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব প্রদর্শনীটিকে ভারাক্রান্ত করেছে। ভাল কাজের সঙ্গে মিশে আছে বেশ কিছু গতানুগতিক ও দুর্বল কাজ।

Advertisement

ভাস্কর্যে মৃণালকান্তি গায়েন গ্রামীণ নিসর্গের উপস্থাপনায় শূন্য পরিসরকে রূপ দিয়েছেন কল্পনাদীপ্তভাবে। নির্মল কুমার মল্লিকের ‘ইন আ সিস্টেম’ শীর্ষক রচনাটিতে কাঠের তৈরি কতকগুলো ঘনক পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে উপরে উঠে গেছে। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে হাহাকার-ভরা মানুষের মুখ। ভাবনা ও আঙ্গিকের দিক থেকে ব্যতিক্রমী ও বলিষ্ঠ রচনা। সিরামিকসের রচনায় ঐতিহ্যগত রূপকে কল্পনাদীপ্তভাবে রূপান্তচরিত করেছেন স্বপন জানা। প্রদর্শনীর অন্য দুজন ভাস্কর রামকৃষ্ণ রাজবংশী ও নব কুমার পাল।

সন্দীপ বাজপেয়ীর ভিডিও ইনস্টলেশনে মোবাইলে তোলা ছবি থেকে অজস্র অসম্পূর্ণ মুখের মিছিলের মধ্য দিয়ে প্রবহমান জীবনের আলেখ্য তৈরি করতে চেয়েছেন। শুভব্রত নন্দী শহরের বহুতল অট্টালিকার সংস্কৃতি থেকে গড়ে ওঠা পরিবেশের সংকটকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভিশন’ শীর্ষক ছবিটিতে বর্গাকার জ্যামিতিক ক্ষেত্রের ভিতর একটি মানুষের মুখ গড়ে উঠতে চাইছে, কিন্তু সম্পূর্ণ হতে পারছে না। এই সংকটের আভাস ছবিটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।

Advertisement

প্রদর্শনীতে অনেক শিল্পীই রূপকে বিশ্লিষ্ট করে কল্পরূপের দিকে নিয়ে গেছেন। তা থেকে নিষ্কাশিত করেছেন অস্তিত্বের সংকট। শেখর ঘোষের একটি ছবিতে দণ্ডায়মান একটি পুরুষের যৌনাঙ্গ দীর্ঘ হয়ে সাপের মতো তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার হাতে ধরা আছে কৃষ্ণের মুখ। অতীশ মুখোপাধ্যায় রূপকথার ধরনে বর্ণিলভাবে মানুষের মুখকে অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকে রূপান্তরিত করেছেন। সুদেষ্ণা হালদার আদিমতার অভিব্যক্তিতে মানব-মানবীর অবয়বকে বিশ্লিষ্ট করে তার সৌন্দর্য ও সংকটের দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন। অঞ্জন দাস স্বাভাবিকতা ও কল্পরূপের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ‘রিগেইন কনসাসনেস’ ছবিটিতে জীবনভাবনার পরিচয় আছে। স্বাভাবিকতাভিত্তিক সুররিয়ালিজমের এক ধরন তৈরি করেছেন বরুণ চৌধুরী ‘রিয়েলিটি চেক’ ও ‘দ্য ডার্কেস্ট ট্রুথ’ শীর্ষক ছবিতে। ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির সঙ্গে জীবনের সংঘাত তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় ভাবনা। প্রদীপ চন্দ এঁকেছেন আধুনিকা যুবতীর শরীর, যা সম্পূর্ণই শরীরময়। স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে দক্ষ শিল্পী শেখর বসুর জলরঙে আঁকা পেঁচার ড্রয়িংধর্মী রূপায়ণগুলি সহজের ভিতর স্নিগ্ধ সৌন্দর্যকে উন্মীলিত করেছে।

দেশীয় ঐতিহ্যগত রূপরীতির ধারাও রয়েছে প্রদর্শনীতে। মিতা রায়ের গ্রামীণ নিসর্গের ভিতর বালক-বালিকার উপস্থাপনা কল্পনাঋদ্ধ। বেলি সরকার বিড়াল নিয়ে কৌতুকদীপ্ত কাজ করেছেন। প্রকৃতির ভিতর চলে যে লোভ ও হিংসার খেলা, এর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তাঁর ছবিতে। প্রকরণ ও আঙ্গিকে দুর্বল হলেও ভাবনার স্বকীয়তা ছবিকে মনোগ্রাহী করেছে। সৌম্যকান্তি মুখোপাধ্যায় ছবিতে লৌকিক ও পুরাণকল্পের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। রণজিৎ শী-র একটি ছবিতে নীলিম অরণ্যে একটি ছাগল আলুলায়িত হয়ে আছে। ঐতিহ্যগত রূপরীতিকে তিনি নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত করেছেন। দীপঙ্কর চন্দ ও শুভজিৎ তলাপাত্র নিসর্গ এঁকেছেন।

তাপস হাজরার ঘোড়ার রূপায়ণ জঙ্গম রেখাচিত্রের দৃষ্টান্ত। কৌশিক দাস প্রাচ্য রূপবোধকে রূপান্তরিত করে ‘অপু’ নিয়ে স্নিগ্ধ নিসর্গ এঁকেছেন। তার ভিতর আলোকচিত্রীয় সৌকর্যে ‘অপু’কে সংস্থাপিত করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন