হিন্দুত্ববাদের ইতিহাসটা বেশ লম্বা, শতাধিক বছরের। কিন্তু আজকের ভারতকে না দেখলে সেই লম্বা ইতিহাসকে ঠিকমতো বোঝা যায় না— অড্রে ট্রুশকে লিখেছিলেন এ কথা, ‘হিন্দুত্ব’স ডেঞ্জারাস রিরাইটিং অব হিস্ট্রি’ নামে প্রবন্ধে (২০২০)। উনি যা বলতে চেয়েছিলেন, সেটা আরও অনেক বেশি স্পষ্ট ভাবে বেরিয়ে এল তনিকা সরকারের সাম্প্রতিক বইতে— ১৯৯১ থেকে ২০২১-এর মধ্যে লেখা আটটি প্রবন্ধের সঙ্কলনে, যার শেষে দাঁড়িয়ে আছে একটি অত্যন্ত জোরালো দাবি। হিন্দুত্বের ইতিহাস, ইতিহাসে হিন্দুত্ব— এ ভারতের অনেক দিনের ঐতিহ্য, দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমে ক্রমে যা বিকশিত আর প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এর মূল লক্ষ্যটাই ছিল— শেষ পর্যন্ত একটি ‘রাজনীতি’ তৈরি করা। তনিকা বলছেন: রাজনীতি ছাড়া এই দীর্ঘ দিনের হিন্দুত্ব প্রকল্পকে বোঝা অসম্ভব। আর তাই, এত দিনে, একুশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে নরেন্দ্র মোদীর ভারতে এসে ওই প্রকল্প একটি সামগ্রিক সাফল্য খুঁজে পেল বলা যায়। প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক উস্কানিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের নানা বন্দোবস্ত দেশ জুড়ে জারি হল। কাশ্মীরে সেনার দমন থেকে উত্তরপ্রদেশে ত্রাসের শাসন, গোরক্ষার গুন্ডামি থেকে রামনবমীর অস্ত্রাভিযান: ভারতে হিন্দুত্ববাদ এখন তার শীর্ষ ছুঁতে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। এমন এক সময়ে হিন্দুত্ববাদের অন্যতম দক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিময় ইতিহাসবিদের কাছ থেকে আসা এই বই বুঝিয়ে দেয়, এক সুদীর্ঘ সময় ধরে হিন্দুত্বের অভিযানকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা কত বড় ভুল করেছি, এবং আমাদের বিস্মৃতির অবকাশে সেই অভিযান কত বেশি শক্তিসঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছে।
ধীর পায়ে কিন্তু অবিচলিত ভাবে হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ, আরএসএস চালিয়ে গিয়েছে তাদের কার্যক্রম। তনিকা দেখিয়েছেন, সারা দেশে ছড়ানো আরএসএস-পোষিত বিদ্যালয়গুলি এক দিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনা করেছে নিজেদের অ্যাজেন্ডায়, অন্য দিকে খুব সন্তর্পণে প্রতিষ্ঠা করেছে এই বিশ্বাস যে, ইতিহাসের মাত্র ‘একটিই’ ভাষ্য হতে পারে, জাতীয়তাবাদেরও— বাকি সব ঝুট হ্যায়! এবং, অবশ্যই, আরএসএস ভাষ্যই সেই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ ভাষ্য, বাকি সব নির্মূল করতে হবে।
হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম ইন ইন্ডিয়া
তনিকা সরকার
৬৯৫.০০
পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, অশোকা ইউনিভার্সিটি
ভাষ্যের ‘বিবিধতা’র প্রতিরোধের পাশে আরও একটি কাজ করা হয়েছে। দেশের বিবিধ জনসমাজকে এই হিন্দুত্বের আঙিনায় আসতে আগ্রহী করেছে। দু’টি কাজের মধ্যে সংঘাত থাকার কথা, কিন্তু আরএসএস সেই সংঘাতকে দক্ষ ভাবে এড়াতে পেরেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে, প্রয়োজনে পরস্পরবিরোধী ভাবেও ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছে— জনজাতিদের মধ্যে এক ভাবে, দলিতদের মধ্যে আর এক ভাবে, উচ্চবর্ণের মধ্যে আরও এক ভাবে। যখন যেখানে যে ভাষ্য উঠে এসেছে, সেখানে সেটিকেই একক, অবিসংবাদী ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ভাবে বিবিধ বাস্তবের দেখাশোনাও চলেছে, বহুত্বের ধারণাটিকে নষ্টও করা হয়েছে।
ফলত ইতিহাসের সঙ্গে এথনোগ্রাফি-র দিক থেকেও গুরুতর পর্যবেক্ষণ পাই এই বইতে, যা বলে দেয় হিন্দুত্ব কোনও স্থির, একশৈলিক আদর্শ বা দর্শন নয়, এটা একটা ডায়নামিক ডিসকোর্স, চলমান, পরিবর্তনশীল আখ্যান। আদর্শে বা অভিমুখে, উদ্দেশ্যে বা বিধেয়-র দিক থেকে হিন্দুত্ববাদ এতটা রাজনৈতিক, এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সমাজে বিভিন্ন ধরনের বলেই তা এত ‘ডায়নামিক’।
নারী-ইতিহাসের অন্যতম দিকপাল ইতিহাসবিদের হাতে হিন্দুত্বের নারী-নীতিটিও নতুন আলোয় আলোচিত হয়। দেখতে পাই, সেটাও কত ভীষণ রকম পরিবর্তনশীল (‘ভীষণ’-এর উৎপত্তিগত অর্থ ভয়ঙ্কর, এখানে সেই অর্থেই রইল শব্দটি)। রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির উপর অধ্যায় দেখিয়ে দেয়, কী ভাবে নারীবাহিনীর মাধ্যমে আশির দশকে হিন্দুত্বের প্রবল উত্থান সম্ভব হয়। হিন্দুত্ববাদের পুরনো নারীস্বাধীনতা-বিরুদ্ধতা সরিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় নারীমুক্তির একটি ‘ভারতীয়’ ধারণা— স্লোগান ওঠে: ‘ভারত কি নারী সর্বদা সে মুক্ত হ্যায়’। কিন্তু তার পর আবারও, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে যখন সত্যিই বাস্তব হয়ে উঠছে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক (রাষ্ট্রিক) সাফল্য, কোথায় যেন পিছিয়ে, সরিয়ে, গৌণ করে দেওয়া হয় আগেকার নারীবাহিনীগুলিকে। নারীবাহিনীর মাধ্যমে যে বিশুদ্ধতার আদর্শ প্রচারিত হচ্ছিল, পরবর্তী রাজনীতির প্রয়োজন পাল্টে যায় বলেই দরকার হয় এই সংশোধিত নব্য পুরুষতান্ত্রিক ‘লাইন’। লক্ষণীয়, যখন দেশ জুড়ে বিজেপির ক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছে, তখন কিন্তু গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা মোর্চার সদস্য সংখ্যা প্রায় একই থেকে গিয়েছে, এবং কর্মকাণ্ড ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে। মহিলা রাষ্ট্রপতির দেশে মহিলা ক্ষমতায়নের প্রয়োজন কোথায় এবং কতটা বলে হিন্দুত্বের শাসকরা ভাবছেন, তা বুঝে নেওয়া যায়।
আগেকার মফস্সল বা ছোট শহরের হিন্দুত্ব শাখাগুলির থেকে ক্রমে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে নাগরিক শাখাসমূহ, যেগুলিতে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্তের দাপট স্পষ্টতই বেশি। ব্যক্তিঅধিকারের বিষয়টিকে আগাগোড়া চাপা দিয়ে রাখা ও বিপজ্জনক বলে দেখানোর ফলে সমস্ত কাজকর্ম এবং সিদ্ধান্তই গোষ্ঠীভিত্তিক, এবং ক্রমশ নেতৃভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়।
বইটি পড়তে পড়তে বোঝা যায়— না, হিন্দুত্ববাদের বিপদ বোঝার পথে বিস্মরণই একমাত্র বাধা নয়। আরও বড় বাধা সম্ভবত ‘সেকুলার’ উন্নাসিকতা, এবং সামাজিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে হিন্দুত্বের প্রকাশ ও বিকাশকে পড়তে চেষ্টা না করা। সেই অত্যন্ত দরকারি কাজটাই করেছেন তনিকা সরকার। আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার এই ‘পড়া’ ও ‘বোঝা’র কাজ। না হলে রাজনৈতিক সংখ্যাগুরুবাদের ভয়াবহ রূপটির সঙ্গে মোকাবিলা করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।