book review

উন্নয়ন ভাবনায় অবহেলিত-ই থাকল

১৯৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে নেহরু তাঁর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া-তে তারকচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে নৃবিজ্ঞানীয় সমীক্ষাকে ভরসা করেছেন।

Advertisement

দীপঙ্কর ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৩৭
Share:

করুণ: মন্বন্তরের কলকাতায় লঙ্গরখানা। মন্বন্তরের নৃবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করেছিলেন তারকচন্দ্র দাস-সহ নৃতাত্ত্বিকরা।

নেশন-বিল্ডিং ইন ইন্ডিয়ান

Advertisement

অ্যানথ্রপলজি: বিয়ন্ড দ্য কলোনিয়াল এনকাউন্টার

অভিজিৎ গুহ

Advertisement

১০৫০.০০

মনোহর

প্রচ্ছদে হারিয়ে-যাওয়া সময়কে মনে করানো সিপিয়া রঙের মাঝে ইরাবতী কার্ভে বা তারকচন্দ্র দাসের ছবি। কিন্তু আমরা জানি কি এই নৃতাত্ত্বিকদের সম্পর্কে? কোন কাজের নিরিখে চিনি বিরজাশঙ্কর গুহ, বিক্রমকেশরী রায়বর্মণ, সুরজিৎচন্দ্র সিংহ প্রমুখকে? নৃতত্ত্ববিদ নির্মলকুমার বসু গান্ধীজির সঙ্গে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে ঘুরছেন তাঁর সচিব হিসাবে। মতে না মিললে যুক্তি দিতেন, এমনকি গান্ধীজির কথাতেও সায় দিতেন না। ওড়িশার মন্দিরস্থাপত্য নিয়ে লিখছেন, আবার সমাজ-সংস্কৃতির চলাচল জানতে জনজাতিদের মধ্যে থাকছেন। এমন বহুপ্রসারী পণ্ডিতদের উপস্থিতি সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদ ও দেশ গঠনের উন্মেষে, নৃবিজ্ঞান গবেষণায় মানুষের শারীরিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক সংযুক্ত চর্চার প্রেক্ষাপট যে কার্যকর হতে পারে, তা বহুলাংশেই অবজ্ঞাত থেকে গেল।

উনিশ শতক থেকে ইউরোপ-আমেরিকার তত্ত্বচর্চার শিক্ষানবিশির যে ধারা ভারতীয় নৃতত্ত্বে প্রবহমান ছিল, তা সমসাময়িক চর্চাতেও স্পষ্ট। এর মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের পঠনপাঠনও একশো বছর পেরিয়েছে। স্বাধীনতার কিছু আগে সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভেও পঁচাত্তর পেরোল। ইতিমধ্যে অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা উন্নয়ন প্রকল্পে শামিল হয়েছেন। নৃতাত্ত্বিকরা তত্ত্বপদ্ধতির নিজস্ব গরিমা নিয়ে আড়ালেই থেকেছেন।

১৯৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে নেহরু তাঁর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া-তে তারকচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে নৃবিজ্ঞানীয় সমীক্ষাকে ভরসা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের নেতৃত্বেই ছিল নৃতত্ত্বের শিক্ষক ও ছাত্রের সম্মিলিত এই গবেষণা। পরবর্তী সময়ে অমর্ত্য সেনও দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে বইতে নানা প্রসঙ্গে এই সমীক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন। তাতে আমরা হয়তো কখনও সজাগ হচ্ছি নৃতত্ত্ব গবেষণার পদ্ধতি ও প্রয়োগ নিয়ে। কিন্তু, জনজাতি বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, বা গ্রামীণ সমাজের গভীর সংবেদী চর্চায় নৃতত্ত্বের যে অনুধ্যান তা এক নজরে দেশজ উন্নয়নকামী পরিকল্পনায় মান্যতা পায়নি। কেন? এই ধোঁয়াশা-ঘেরা অথচ জরুরি কথাগুলিই বলতে গিয়ে নৃতত্ত্ববিদ অভিজিৎ গুহ তাঁর পূর্বসূরিদের বিদ্যাচর্চার তীক্ষ্ণ নিরীক্ষণ করেছেন। দেশহিতৈষী কার্যক্রমের চিন্তা-চেতনায় নৃতাত্ত্বিকদের যে দৃষ্টিগ্রাহ্য ভূমিকা থাকতে পারে, তার সূত্র অনুসন্ধান ও ব্যাপ্তির খোঁজই লেখক করেছেন। উন্নয়নের দিশা তো নৃতত্ত্বেরও এক দিকনির্দেশক কাজ হিসাবে বিবেচ্য হওয়া উচিত। কোন পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রাসঙ্গিক— পাওয়া না-পাওয়ার খতিয়ান কি আদৌ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আমাদের?

স্বাধীনতার পরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে সুরজিৎচন্দ্র সিংহের, এবং এই শরণার্থীদের নিয়ে সামাজিক উত্তেজনার বিষয় সন্ধানে বিরজাশঙ্কর গুহের গবেষণা, বিক্রমকেশরী রায়বর্মণের সমীক্ষায় জনজাতি ও অন্য পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর, রৌরকেলায় বৃহৎ শিল্পকাঠামো গড়ে ওঠায় স্থানচ্যুতি ও পুনর্বাসনের দিক আশাপ্রদ ভাবে উঠে এসেছিল। কোয়না বাঁধ তৈরিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নানা তথ্য খোঁজা, ইরাবতী কার্ভে ও জয় নিম্বকারের এই জাতীয়তাবাদী কল্যাণমুখী প্রক্রিয়াতেই অংশগ্রহণ। বহুলাংশে অজ্ঞাত এই জাতীয় সংস্কারবাদী গবেষণা অনুসন্ধানে নতুন ধারার খোঁজ তাই সংশ্লিষ্ট নৃবিজ্ঞানীদের জীবন ও কাজের খতিয়ানের মধ্যেই পরিস্ফুট হয়েছে। আবার, কী নেই কী আছে— অসম্পূর্ণতা থেকে সম্ভাব্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পের সূত্রে তথ্যনিবিষ্ট ও দিশানির্দেশক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন লেখক। নৃতত্ত্বের অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে মানুষের জীবনসংস্কৃতির যে নিবিড় ধরন থাকে, তা যে কোনও পরিকল্পনায় অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে। নৃতত্ত্ব গবেষণায় পর্যবেক্ষণ, বংশলতিকা তৈরি ও বিষয়ভিত্তিক বিস্তৃত খোঁজের সম্মিলিত পদ্ধতির নিজস্বতা আছে। বিষয় হিসাবে নৃতত্ত্বের অন্তঃপুরে জেগে আছে যে জাতীয়তাবাদী ভাবনার উপকরণ— তা অন্বেষণ ও বিশ্লেষণের দীর্ঘ সূচনাপর্বের কাল পেরিয়ে পরিব্যাপ্ত উন্মোচন এই বই।

নৃতত্ত্বের এই সফর বহু ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে লেখকের অভিযোগেরও খতিয়ান। শরৎচন্দ্র রায়, ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, এমনকি অম্বেডকর এবং সমাজ-জাতি-শ্রেণি গবেষণায় তাঁদের নানা দিকের দৃষ্টিপাত— সেই উনিশ শতকের সূত্র ধরে। লিটল আন্দামানবাসী ওঙ্গে জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রণবকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের দীর্ঘ দিন গবেষণার ফলে পাওয়া তথ্যের প্রয়োগ ঘটেনি। নারকেল গাছ-সহ দরকারি চাষাবাদ, বা শরীরের লোহা ঘাটতির স্বাস্থ্যশিবির করেও সমস্যার সবটা মেটানো যাচ্ছিল না। কয়েক দশক আগে মহামারির কবলে পড়ে ওঙ্গেরা স্থান ত্যাগ করে লিটল আন্দামানে এসে বসতি করেছিল। দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় পুনরায় তাঁদের নির্বিঘ্নে আগের পরিবেশে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া গেলে অনেক বেশি উপযোগী হত। কিন্তু বাস্তবিকই নীতিনির্ধারণে এ সবে আর কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়?

স্বদেশচর্চা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বহুলাংশেই নৃতত্ত্বের তত্ত্বপদ্ধতির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। যে বিষয়ের অগ্রণী ভূমিকা থাকার কথা, তাতে কেন ঘাটতি থেকে গেল? মিশনারির কাজে বিদেশ থেকে এসে অক্সফোর্ডের নৃতাত্ত্বিক ভেরিয়ার অ্যালুইন ভারতীয়ত্বে নিজেকে মিশিয়ে দিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতি উন্নয়নের পরামর্শদাতাও হলেন। এ চিত্র ব্যতিক্রমী। নৃতত্ত্বের উন্নয়নকামী ভাবনার উন্মোচনে বরাবর এক জাড্য মিশে থাকছে। এই পর্দা সরবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন