যেন একটু গ্রিক ব্যাপার ছিল

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ও গদ্যকাররা প্রথম কমিউনিস্ট দৈনিকে একই সঙ্গে সাংবাদিকতা ও কবিতার ধরতাই বদলে দিচ্ছেন। শ্রেষ্ঠতা যেন এমনই সহজ করায়ত্ত।

Advertisement

দেবেশ রায়

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৯ ০৫:৪৭
Share:

বাঙ্ময়: সমকালীন আধুনিকতাকে অন্য এক বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিষ্ণু দে।

অশোকবাবু ঠিক লেখক বা গবেষক বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন না। তিনি চিন্তাবিদ ছিলেন। কিন্তু সারা জীবন উচ্চতম বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলিতে প্রথাসিদ্ধ শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা পরিচালনা করেছেন অথচ নিজে কোনও একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ-গবেষণা করেননি। যেটুকু লিখেছেন, তা একেবারে নিরেট গবেষণা— তথ্যের নতুন বিন্যাসে ও তারই ওপর নির্ভর করে নতুন তত্ত্ব। তাঁদের প্রজন্মের মার্ক্সবাদী বিদ্বানদের যেন একটু চাপা সিনিসিজ়মই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার ব্যাপারে।

Advertisement

এই ধরনটা আমাদের প্রভাবিত করেছিল। কোনও রকমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করে একটা চাকরি জোটানো অথবা পার্টির সব সময়ের কর্মী হয়ে জেল খাটা। জেলে থেকেই, বা ছাড়া পেয়েই, এমএ পরীক্ষা দিয়ে সবচেয়ে ভাল রেজ়াল্ট করা। রণজিৎ গুহ, সুনীল মুন্সি, অবন্তী সান্যাল, নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায় এঁরা সবাই এই ঘরানার উজ্জ্বল যুবক ছিলেন। তাঁদের দেখাদেখি আমরাও। উজ্জ্বলতাটুকু বাদ দিয়ে।

একটু যেন গ্রিক ব্যাপার ছিল— এই জীবনাচরণে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ও গদ্যকাররা প্রথম কমিউনিস্ট দৈনিকে একই সঙ্গে সাংবাদিকতা ও কবিতার ধরতাই বদলে দিচ্ছেন। শ্রেষ্ঠতা যেন এমনই সহজ করায়ত্ত।

Advertisement

এই জীবন-অভ্যাসে যে একটু গ্রিক ব্যাপার ছিল, সেটা অশোকবাবুই একদিন, অসংখ্য আলাপের একদিন, আমাকে বলেছিলেন। বাঙালি গ্রিকপনার এমন উদাহরণে চমকে উঠেছিলাম।

অশোকবাবুর রচনার এমন শোভন একটি সঙ্কলনের যোগ্যতর সম্পাদক আর কে হতে পারেন, সৌরীন ভট্টাচার্য ছাড়া? আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এমন নিষ্ঠাবান পাঠক, মার্ক্সবাদ অধ্যয়নে নিতান্ত মনোযোগী, বিপ্লবচর্চায় দেশ ও বিদেশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম টানাপড়েন, বিপ্লব যে পূর্ব-স্থিরীকৃত কোনও কর্মসূচির অন্ধ অনুসরণ মাত্র নয়, বিভিন্ন বিপ্লবী দেশের সংজ্ঞা যে আলাদা হতে পারে ও সেই দেশগুলির মধ্যে যে স্ববিরোধিতাও থাকতে পারে, এমনকি বড় দেশ ও ছোট দেশের মধ্যেও বিরোধ— এ-সমস্ত বিষয়ে প্রখর সচেতনতা আমাদের সমকালীনদের মধ্যে সৌরীনবাবুর মতো আর-কারও ক্ষেত্রে তো পাই না।

ইতিহাসের তর্কে বিতর্কে
অশোক সেন, সম্পা: সৌরীন ভট্টাচার্য
৫৫০.০০
কারিগর

তাই, এই সঙ্কলন গ্রন্থের ভূমিকায়, ‘সমাজবিজ্ঞানের এক ঘরানা’ শিরোনামে সৌরীনবাবু যে অত্যন্ত জরুরি কথা অত্যন্তই সংক্ষেপে উত্থাপন করেছেন, তা আর-একটু বিস্তারিত হওয়া আমাদের দেশের ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেহাতই বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। এ কথা ঠিক অশোকবাবুর সমাজবিজ্ঞানের ঘরানা বোঝার পক্ষে এই ভূমিকাটি নির্দিষ্ট ভাবে অনিবার্য ছিল, তার সঙ্গে-সঙ্গে এ-কথাও সমান সত্য যে, ‘‘অর্থনীতি যে সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত এক বিদ্যাক্ষেত্র, এ কথাটা এখনও মুখ ফুটে কেউ ঠিক অস্বীকার করেন না। তবে আচারে আচরণে মনে হয় কথাটা বেশির ভাগ সময়ে ভুলে থাকাই রেওয়াজ’’; ‘‘পোলিটিকাল ইকনমি থেকে ইকনমিক্সের যাত্রাপথে ইতিহাসের পটভূমি যেন ক্রমে দূরে সরে গেছে’’; ‘‘আঠারো শতকের বিকশিত পুঁজিতন্ত্রই যেন ইতিহাসের চরম পরিণতি’’; ‘‘এই ঝোঁকটা ডেভিড রিকার্ডোর মধ্যে হয়তো কিঞ্চিৎ বেশি ছিল। জার্মান হিস্টরিকাল স্কুলের চিন্তায় এই ঝোঁকের এক সমর্থ সমালোচনা পাওয়া যায়’’— এই প্রত্যেকটি সূত্র অনেক বিশদ হতে পারত। তেমন বিশদ হলে ‘অশোক সেনের চর্চা ও চিন্তায় ইতিহাসের জায়গা অনেক প্রত্যক্ষ’ এমন প্রয়োজনীয় স্থান নির্ধারণের চাইতেও আমাদের অন্তত ব্যক্তিগত এই উপকার হত— বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ঔপনিবেশিকতার কার্যকারণে বিবেচনা করার যে-চেষ্টা একটু-আধটু করছি গল্প-উপন্যাসের নির্দিষ্ট আকারের বদলের সঙ্গে-সঙ্গে তার একটা প্রয়োজনীয় সমর্থন জুটত। অশোকবাবু থাকলে তাঁকেই কথাটা বলা যেত, তাঁর অনুপস্থিতিতে সৌরীনবাবু ছাড়া তো কাউকে দেখছি না। একটু বিশদ করে লিখুন-না। বাংলার নিজস্ব প্রয়োজনে উপনিবেশ ও উপনিবেশোত্তরতার ব্যাখ্যার নতুন বিস্তার প্রয়োজন। অশোকবাবুর অনুপস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব আমাদের গিলে খাচ্ছে।

এই বইয়ে সঙ্কলিত লেখাগুলির বাইরে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অশোক সেনের একটি বই বিশ্বভারতী (রাজনীতির পাঠক্রমে রবীন্দ্রনাথ) প্রকাশ করেছিল। ‘রবীন্দ্রনাথের স্বাবলম্বন’ সংক্রান্ত লেখা দু’টি পুরনো, রবীন্দ্রশতবর্ষের। এই ‘স্বাবলম্বন’ সংক্রান্ত লেখা দু’টি, এখনও যে প্রবল প্রাসঙ্গিক, তা পুনঃপাঠে বোঝা গেল।

একটু কৌতুকের সঙ্গেই লক্ষে আসে যে প্রথম নিবন্ধটি লেখার পর অশোকবাবুর ভাষা ও সূত্রনির্মাণ এক সাবলীলতা পেয়ে যায়। দ্বিতীয় লেখাটিতে তাঁর এমন স্পষ্টতা, ‘‘ইংরেজি জ্ঞানের লিবারল চুক্তি ও পরাধীন অস্তিত্বের অন্তর্বিরোধে রবীন্দ্রনাথ চিরদিন ব্যষ্টিপ্রধান স্বার্থবিচারের ঊর্ধ্বে পুরুষার্থের মুক্তি চেয়েছেন।’’ (পৃ ৭৫)

দ্বিতীয় প্রবন্ধটির এই অংশের সঙ্গে গভীর অন্বয়ে মিশে যায়— প্রথম প্রবন্ধে ‘গোরা’ ও ‘চতুরঙ্গ’-এর ব্যাখ্যা— বইয়ের ৪৮ ও ৪৯ পৃষ্ঠা। আমরা যদি এই অংশ দু’টিকে যুক্ত করে নিতে পারি শঙ্খ ঘোষের নির্মাণ ও সৃষ্টি-র প্রাসঙ্গিক অংশের সঙ্গে তা হলে চমকে উঠতে হয়— রবীন্দ্রনাথের এই দীর্ঘ দীর্ঘ সমকালীনতায় (১৯০৮ থেকে প্রায় ১৯৪০ই)।

দুই জায়গায় (৪০ ও ৪১ পৃষ্ঠায়) অশোক সেন বলেছেন ‘‘রেনেসাঁসের প্রচণ্ড পরাক্রম নয়, রিফর্মেশনের নিপীড়িত কঠোর আত্মজিজ্ঞাসাও নয়, এই উদারতন্ত্রের দর্পণেই ব্যক্তিমুক্তির আদর্শের সঙ্গে উনিশ শতকের বাঙালি নব্য মধ্যবিত্তের প্রাথমিক পরিচয় ঘটেছিল।’’ আর ‘‘উদারতন্ত্রের ছকের মধ্যে ঐতিহ্যের নির্বাচনকে মিলিয়ে নেওয়ার বিড়ম্বনা রাবীন্দ্রিক সমাধানেও লক্ষণীয়।’’

আমাদের প্রাক-ইংরেজ সৃষ্টিশীল সাহিত্যের নতুন বিচার-বিবেচনায়, সম্ভবত এখানে অশোকবাবু কলোনির জীবনের তাত্ত্বিক বাধ্যতা ভুলতে পারেননি। আগেও একবার বলেছি— অশোকবাবু যে রাবীন্দ্রিক স্বাবলম্বনের বাস্তবকে বাঙালির জীবনযাপনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, তার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন প্রাক-ইংরেজ সৃষ্টিশীল বাংলা সাহিত্যের নতুন মৌলিক ইতিহাস, একই সঙ্গে প্রাক-ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তর।

এই বইটি পড়তে-পড়তে এই জায়গায় এসে আমার মনে এই জিজ্ঞাসাটা একটু আকস্মিক এল— অশোকবাবুরাও কি অত স্পষ্ট ভাবে না হলেও, এক অস্পষ্টতায়, বুঝতে চাইছিলেন যে তাঁরা সমাজ বিবর্তনের যে সৃষ্টিশীল সমাধান খুঁজছিলেন, তাতে সাহিত্য এক প্রধান অবলম্বন, প্রায় শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। সেই জন্যই তাঁদের একজন বিষ্ণু দে-র এত প্রয়োজন ছিল। তাঁরা কেউই প্রাক-ইংরেজ বাংলা সাহিত্য খুব অভিনিবেশের সঙ্গে পড়েননি। হয়তো, তাঁরা মনেও করতেন না— প্রাক-ইংরেজ বাংলা সাহিত্যে, চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি, চৈতন্যজীবনী, ভারতচন্দ্রে পুনরুদ্ধারযোগ্য আধুনিকতা সঞ্চিত ছিল। কিন্তু তাঁদের একজন কবির বড় প্রয়োজন ছিল যিনি তাঁদের সমকালীন আধুনিকতাকে অন্য এক বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারবেন। তাই উর্বশী ও আর্টেমিস, চোরাবালি, পূর্বলেখ, সাত ভাই চম্পা, সন্দ্বীপের চর-এর কবিকে তাঁরা আবিষ্কার করেই চললেন।

এ বড় কম বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড নয় আর সে ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক বিস্তার ও গভীরতাও বিরাট। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে-কবিতায় যে-পূর্ববঙ্গ থেকে নির্মাণ করেছিলেন একই সঙ্গে সৌন্দর্যের এক অনিঃশেষ সৌন্দর্যভূমি ও সেই অপার্থিব সৌন্দর্যভূমিতে প্রতি দিনের হাহাকারের জীবন ও জীবনের এক বাধ্য মিথ্যা প্রতি দিন— বিষ্ণু দে-ও, তাঁর সৃষ্টিপ্রাচুর্যে তেমন ব্যাপকতার অভাব সত্ত্বেও সেই পরাক্রান্ত ও সৌন্দর্যের জগৎকে সত্য করে তুলেছিলেন। অশোকবাবু যে-ক’টি কাব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলির পর বিষ্ণু দের কবিতা যেন নতুনতর তাৎপর্যে বাঙ্ময় সুন্দর হয়ে উঠছিল।

‘‘বিষ্ণু দের কবিস্বভাবের বৈশিষ্ট্য তিনি নৈর্ব্যক্তিক বিষয়লগ্ন দৃষ্টিকোণ পুনরুদ্ধার ও বিকাশের প্রয়োজন মর্মে মর্মে ও কবিকর্মে বুঝলেন এবং তাঁর গত ত্রিশ বৎসরের কাব্যধারায় ওই মহৎ আদি চেতনার দায়িত্ব মুদ্রিত।’’ (পৃ ৮৯)। পাঠক তাঁর কবিকে চিনে নিচ্ছিলেন ও কবিকে চিনতে পারছিলেন— ‘‘তাই যদি হয় তাই হোক হার মানিনি কখনো/ আমরা, জনতা, জনসাধারণ, সাধারণ লোক/ চাষি ও মজুর কবি শিল্পী স্রষ্টা/ রাত্রি আজ করে দিই দিন তুড়ি দিয়ে শনিকে রাহুকে’’ (‘১৪ই অগস্টে’, অন্বিষ্ট)।

কলকাতা কেন গ্রিক যেন একটু আভাস পাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন