book review

Book review: আড়ালে থেকেও ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে

সুকুমার-সত্যজিতের জীবন সদা-আলোচিত, তবু তাঁরা স্পর্শাতীত। সুপ্রভা আড়ালে থেকেও ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২২ ০৮:০০
Share:

সুপ্রভা রায়: দি আনভ্যানকুইশড
টুম্পা মুখোপাধ্যায়
৫০০.০০
আভেনেল প্রেস

Advertisement

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর শাশুড়িমা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন সাদা থান না পরেন। নারী শিক্ষার সমর্থন, কুলীন প্রথার বিরোধিতার মতো, হিন্দু বিধবাদের কঠোর, রিক্ত জীবনচর্যার বিধানও গ্রহণ করেননি ব্রাহ্মরা। অথচ, সেই উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমারের ছত্রিশ বছর বয়সে অকালমৃত্যুর পরে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে থান ধরেছিলেন সুপ্রভা রায়। আরও সাঁইত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন, ওই এক বেশে। হাতে একটি আংটি ছাড়া কোনও গয়না পরেননি, নিরামিষ খেয়েছেন। ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা ও বধূ, বেথুন কলেজের গ্র্যাজুয়েট সুপ্রভার যথেষ্ট পরিচয় ছিল তৎকালীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রণী ব্যক্তিদের সঙ্গে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের টুলুকে গান শিখিয়েছেন। সে সময়ে বিধবা-বিবাহের নজির কম ছিল না, সপুত্রকন্যা মহিলাদেরও দ্বিতীয় বিবাহ হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন হিন্দু বিধবার মতো বাঁচলেন সুপ্রভা?

সুপ্রভা রায়ের এই জীবনী থেকে যা মেলে, তা বহু সচ্ছল পরিবারের মেয়ের জীবনরেখা— শৈশবে পড়াশোনা, গান, বিয়ের পরে বৃহৎ পরিবারে বড় বৌঠান, তার পর ছোট ভাইয়ের সংসারে বিধবা মেজো পিসি। সন্তান মানুষ করতে সেলাই দিদিমণি, নিজের তৈরি হস্তশিল্প বিক্রি— কিন্তু কর্মজীবনে, কিংবা শিল্পজগতে, নিজের পরিচিতি তৈরির চেষ্টা করেননি। সুপ্রভা সামান্য ছিলেন না— দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী (দেওর সুবিমল তাঁকে বলতেন, বজ্রবৌঠান), রন্ধন, সঙ্গীত, সূচিশিল্প, ভাস্কর্যে অতি পারদর্শী। তবু যেন গৃহিণীপনার আড়ালে রয়ে গেলেন তিনি। বোন কনক দাস সুপ্রসিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সুপ্রভার গানের রেকর্ড পাওয়া যায় কেবল কোরাসে। ব্রাহ্মিকা সমাজ, বঙ্গ মহিলা সমাজ কিংবা নারী হিতসাধিনী সভার মতো সংগঠনে তাঁকে পাওয়া যায় না। বেথুন কলেজের শতবার্ষিকী স্মারক পত্রিকায়, সংসদ চরিতাভিধানে তাঁর নাম বাদ পড়ে গিয়েছে। কতটা সাম্যময় ছিল তাঁর দাম্পত্য, কী ব্যবহার পেয়েছিলেন যৌথ পরিবারে, কেমন ছিল তাঁর একক মাতৃত্ব, সুপ্রভার প্রসঙ্গে সে সবেরই আভাস মেলে শুধু।

Advertisement

এর একটা কারণ, যা নিয়ে লেখক আক্ষেপ করেছেন, তা হল সুপ্রভা কিছুই লিখে যাননি। তাঁর পরিবারেরই সুখলতা, পুণ্যলতা, লীলা, নলিনীরা সাহিত্যে আঁচড় কেটেছেন, স্মৃতিকথা লিখেছেন পুত্রবধূ বিজয়াও। সুপ্রভার কিছু চিঠিপত্র মেলে কেবল। অপর সম্ভাব্য কারণ, যা লেখক উল্লেখ করেননি, তা হল অভিজাতদের পারিবারিক ভাবমূর্তি সম্পর্কে স্পর্শকাতরতা। এর জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট হয়েছে, অপ্রকাশিত থেকেছে। জীবনীকার সেই ফাঁক ভরাতে মানবীবিদ্যার তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন: উনিশ শতকে মেয়েদের জীবন কেমন হত, তা থেকে সুপ্রভাকে বুঝতে চেয়েছেন। কিন্তু যে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি অতীতের অবয়বকে পাঠকের কাছে রক্তমাংসের মানুষ করে তোলে, তার অভাব রয়ে গিয়েছে। বইটির লিখনশৈলী ত্রুটিহীন নয়। ইংরেজি হরফে লিখিত বাংলা কবিতায়, চিঠি প্রভৃতির ভাষান্তরে সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল।

শেষ অবধি কিছু সুখ-দুঃখের গল্পই প্রাপ্তি হয়ে থেকে যায়। যেমন ভাইয়ের বাড়ি থেকে শেষ অবধি মা-ছেলের সংসার পাতার পর মানিকের ভাত খাওয়া দেখে সুপ্রভা টের পান, মামার বাড়িতে খিদে পেটে উঠে যেত সে। সে দিন কেঁদেছিলেন সুপ্রভা। সুকুমার-সত্যজিতের জীবন সদা-আলোচিত, তবু তাঁরা স্পর্শাতীত। সুপ্রভা আড়ালে থেকেও ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন