চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

যন্ত্রণা থেকেও জেগে ওঠে প্রতিবাদের ছবি

চলছে সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো ও কলকাতা আর্ট উৎসব। দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। ঋত্বিক ঘটকের একটি সিনেমায় প্রায় আর্তনাদের মতো ধ্বনিত হয়েছিল এই শব্দ দুটি। যন্ত্রণা থেকেই জেগে ওঠে প্রতিবাদ, যা মানুষের মানবতাবোধের শ্রেষ্ঠ এক অভিজ্ঞান’। প্রায় সমস্ত কলকাতা পরিব্যাপ্ত করে এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যে সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো, কলকাতা আর্ট ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ তার অন্তর্গত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

শিল্পী: হরেন্দ্রকুমার কুশওয়াহা।

ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। ঋত্বিক ঘটকের একটি সিনেমায় প্রায় আর্তনাদের মতো ধ্বনিত হয়েছিল এই শব্দ দুটি। যন্ত্রণা থেকেই জেগে ওঠে প্রতিবাদ, যা মানুষের মানবতাবোধের শ্রেষ্ঠ এক অভিজ্ঞান’। প্রায় সমস্ত কলকাতা পরিব্যাপ্ত করে এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যে সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো, কলকাতা আর্ট ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ তার অন্তর্গত। চারটি প্রদর্শনী দেখে ওঠার পর এ রকমই প্রতিক্রিয়া জাগতে পারে দর্শকের মনে। সারা দেশের তরুণ শিল্পীরা সামগ্রিক এক প্রবহমান বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যেন সমবেত প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে চেয়েছেন তাঁদের ভাবনা ও আঙ্গিকের দৃশ্য-প্রকল্পের ভিতর দিয়ে।

Advertisement

মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে পরিত্যক্ত জেম সিনেমায় দেখানো হচ্ছে যে অজস্র ইনস্টলেশন ও ভিডিও-ইনস্টলেশন সেই আবহ এখানে অনেক স্পষ্ট। এই সিনেমা হলের দ্বিতলের প্রথম কক্ষে রয়েছে মূল প্রতিযোগিতার বাইরে আমন্ত্রিত কয়েকজন শিল্পীর ইনস্টলেশনধর্মী রচনা। বীণা ভার্গব পোড়া কাঠ, পরিত্যক্ত ধাতবপাত ও যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করেছেন এক বিমূর্ত রচনা যাতে এই দহনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্পষ্ট। এই ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করে কিংশুক সরকার, রেশমি বাগচি সরকার, প্রশান্ত সাহু ও সদ্য-প্রয়াত সুমিত্র বসাকের রচনাগুলিও। প্রশান্ত সংবাদপত্র মুড়িয়ে সুতোর বুননে তৈরি করেছেন ঝুলন্ত দৃশ্যপট, যাতে ছড়ানো রয়েছে আজকের নানা দুঃসংবাদ, তার শিরোনাম সংবাদের সমুদ্র।

দ্বিতীয় কক্ষে দর্শককে বিপর্যস্ত ও অভিভূত করে অপূর্ব রায়ের রচনা ‘ক্ষুধার্ত পিপীলিকা’। ঝাঁক ঝাঁক পিপড়ে নীচ থেকে উপরের দিকে উঠে গিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে আবৃত করেছে বুদ্ধর মুখ। যেন শান্তির উপর সন্ত্রাসের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন। শরৎ রায় কাঠের অজস্র ছোট ছোট পুতুল তৈরি করে অদৃশ্য সুতো ঝুলিয়ে দিয়েছেন ছাদ থেকে। এই রচনাটি পেয়েছে প্রথম রানার আপ পুরস্কার।

Advertisement

আর দ্বিতীয় রানার আপ পেয়েছেন মন্টু দাস তাঁর ‘চেঞ্জিং নেশন, চেঞ্জিং আইকনস’ শীর্ষক ভিডিও ইনস্টলেশনের জন্য। জাতীয়তার প্রতীক পাল্টে যায় ক্ষমতার আগ্রাসনের বিবর্তনের সঙ্গে। তৃতীয় তলে দেখানো হয়েছে মানস আচার্য পরিকল্পিত ‘শিফটিং ন্যারেটিভস’ শিরোনামের ভিডিও ইনস্টলেশনের স্বতন্ত্র একটি প্রকল্প। এতে অংশ গ্রহণ করেছেন মধুজা মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস বারুই, সুকান্ত মজুমদার প্রমুখ শিল্পী।

আরও যে চারটি গ্যালারি বা প্রদর্শ-পরিসরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে প্রদর্শনী, সেগুলো হল সিমা, স্টুডিও-২১, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস ও ডোভার পার্কের একটি পুরনো বাড়ি ও উদ্যান। অল্প কিছু অলটারনেটিভ আর্টের সঙ্গে সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে প্রচলিত ধারার ছবি ও ভাস্কর্য। কিন্তু সেই প্রচলিত ধারাও আজ অনেক রূপান্তরিত। ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু হয়েছিল বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদের প্রকল্প। সেই বিশ্বায়ন যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, আজ তা প্রমাণিত।

রবীন্দ্রনাথ রায়ের রচনা ‘ডেস্ট্রাকশন’-এ এই ধ্বংসের আবহ। সমস্তই পুড়ছে। শুভাশিস দত্তের এচিং-এ পিকাসোর ধ্বংসের প্রতীকী প্রতিমাগুলি রূপান্তরিত হয়। অভিষেক নারায়ণ ভার্মা যাঁর ‘এ গেম অব পারমুটেশনস অ্যাণ্ড কম্বিনেশন’ শীর্ষক লিথোগ্রাফি ‘ডিরেক্টর্স চয়েস’ পুরস্কার পেয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে ধাবিত হচ্ছে আজকের যৌবন।

পরিব্যাপ্ত ধ্বংসের মধ্যেও নতুন দিশার সন্ধানে উন্মুখ আজকের যৌবন। সেই সন্ধান ও সহজের সাধনাকেই শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘সিমা অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। শিল্পীর নাম হরেন্দ্রকুমার কুশওয়াহা। তিনি নেপালি কাগজ দীর্ঘ করে কেটে সুতোর বুননে জুড়ে তৈরি করেছেন একটি বস্ত্রসম ঝুলন্ত প্রদর্শ, যাতে গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য ও দৈনন্দিনতা প্রতীকায়িত হয়েছে। স্বশিক্ষিত শিল্পী প্রতাপচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর সুদক্ষ রচনায় এঁকেছেন একটি পুরনো সেলাই মেশিনের ছবি। পরিত্যক্তের করুণার মধ্যে জাগাতে চেয়েছেন প্রাক্তনের স্মৃতি। এই স্মৃতিরই নানা রূপ দেখি তানিয়া বিশ্বাসের কলাগাছের রূপায়ণে বা বলাকা ভট্টাচার্যের কল্পিত নিসর্গ ‘এ ড্রপ অব মাই ইয়ালো ফিল্ড’ শীর্ষক রচনায়। এক দিকে শুভান্বিতা সাহার মাইকেল-অ্যাঞ্জেলোর অনুসারী ভাস্কর্য ‘পিয়েতা’-র করুণা, অন্য দিকে উপরোক্ত সহজের সাধনা, এর মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে পুড়তে থাকা আজকের জীবন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন