পুস্তক পরিচয় ২

সামনেই ভাত, তা বোঝার অবস্থা তার নেই

দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, যুদ্ধ, দেশভাগের সময়ে যে মানুষরা বেঁচে ছিলেন, সেই সময়টা এখনও বেঁচে আছে তাঁদের মধ্যে। অগণিত নামগোত্রহীনের মৃত্যু দিয়ে তৈরি হয়েছে তাঁদের জীবনবোধ।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

হাংরি বেঙ্গল/ ওয়ার, ফেমিন, রায়টস অ্যান্ড দ্য এন্ড অব এম্পায়ার। জনম মুখার্জি। হার্পার কলিন্স, ৪৯৯.০০

দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, যুদ্ধ, দেশভাগের সময়ে যে মানুষরা বেঁচে ছিলেন, সেই সময়টা এখনও বেঁচে আছে তাঁদের মধ্যে। অগণিত নামগোত্রহীনের মৃত্যু দিয়ে তৈরি হয়েছে তাঁদের জীবনবোধ। কিন্তু ইতিহাস তাকে উপাদান করতে চায় না। পরিচিত পাঠ্যে তারিখ, নেতা, ঘটনা পরপর সাজিয়ে একটা নকশা মেলে। অমন ইতিহাস নিজের পরিবার, শহর, সেদিন-এদিন মিলিয়ে বোঝার খিদেটা মেটাতে পারে না। সেই অসন্তুষ্টির বোধ থেকে জেমস ইয়ং প্রাণ-নিয়ে-ফেরা ইহুদিদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন হলোকস্টকে বুঝতে। উর্বশী বুটালিয়া ভারত ও পাকিস্তানের একদা-উদ্বাস্তু পরিবারে গিয়ে দেশভাগের গল্প শুনেছিলেন। মধুশ্রী মুখোপাধ্যায় বেশ্যাবৃত্তিতে আসা মেয়েদের জীবনের গল্প জেনেছেন, দুর্ভিক্ষকে বুঝতে। ঘটনার অভিঘাতে পাল্টে-যাওয়া জীবনগুলোকে বুঝে তাঁরা সেই সব ঘটনাকে বুঝতে চেয়েছেন। এ শুধু তথ্যের নয়, অর্থের অনুসন্ধান।

Advertisement

জনম মুখোপাধ্যায় সেই তাগিদ থেকে বই লিখেছেন। ভারত থেকে বহু দূরে, বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের বহু পরে তাঁর জন্ম। তবু মন্বন্তর নিয়ে ঘর করেছেন, কারণ তাঁর বাবা সেই অসহ্য দুঃখ বয়ে চলেছেন। দুর্ভিক্ষের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জনম দেখেছেন, সে সময়ে যাঁরা বালক ছিলেন, তাঁদের বুদ্ধির কাছে স্পষ্ট হয়নি চারদিকে কী হচ্ছে। অথচ রাস্তায় কঙ্কালসার দেহ, বোমা পড়ার আতঙ্ক, দাঙ্গার বীভৎসতা তাঁদের মনে ভারী চাপের মতো রয়ে গিয়েছে। তবে মন্বন্তরকে বুঝতে সে সময়ের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বললেও, ঠিক উর্বশী বা মধুশ্রীর পথে হাঁটেননি জনম। পেশাদার গবেষকের মতোই সরকারি নথি, চিঠিপত্র, সরকার নিয়োজিত নানা কমিটির রিপোর্ট, সংবাদপত্র, এমন বহু সূত্র ঘেঁটেছেন। এ সব উপকরণ থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ বিপন্নতার যে ছবি, তা ঠিক বিকল্প ইতিহাস নয়। প্রথাগত ইতিহাসকে আরও নিবিড় ভাবে দেখেছেন তিনি। বহু সূত্র থেকে তথ্য-বিবরণ কাজে লাগিয়েছেন বুঝতে, কী করে মানুষ থেকে অমানুষ, তা থেকে মৃতদেহ তৈরির পালা চলেছিল বাংলায়। এ বই মন্বন্তরে মৃত ত্রিশ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাস।

পঁচাত্তর বছরের ব্যবধানে সেই সময়ের আন্দাজ করা সহজ নয়। আজ রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দু’টাকা কিলো দরে চাল পাচ্ছে। সে দিন চালের অভাবে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মরে গিয়েছিল। দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে খেতে না-পাওয়ার পালা চলেছিল। এমনকী যখন সরকারি ভাবে দুর্ভিক্ষের সমাপ্তি ঘোষিত, সেই ১৯৪৪ সালেও ঢাকার কাছে একটা গ্রামে গিয়ে এক সাংবাদিক দেখেছেন, অনাহারে ঝুঁকে-পড়া এক তরুণী সাতজনের জন্য আধ সের চালের ভাত রাঁধছে। ঘোমটার নীচে তার চোখের জল ঝরে পড়ছে হাঁড়িতে। ‘‘এমন কত গ্রামে মেয়েদের নোনা চোখের জল দিয়ে ভাত খাচ্ছে লোকে?’’ লিখেছেন পঞ্জাবের সেই সাংবাদিক। এমন লাগাতার খাদ্য-বঞ্চনা কী করে সম্ভব হল, ইদানীং তা নতুন করে বোঝার কিছু চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

Advertisement

সাংবাদিক মধুশ্রী মুখোপাধ্যায় চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার বইটিতে দেখিয়েছেন, ওই একটি লোকের ভারতবিদ্বেষ কী ভাবে চালের আকাল তৈরি করেছিল। ‘খরগোশের মতো প্রজননরত’ ভারতীয়দের জন্য চাল বইবার জাহাজ দিতে তিনি রাজি হননি। যদি জাহাজ যুদ্ধে লাগে? প্রয়োজনের চাইতেও বেশি চাল ভারত থেকে তুলে মধ্যপ্রাচ্যে মজুত রেখেছিলেন। যদি দরকার হয়? অন্য দেশের সাহায্য আটকে দিয়েছিলেন, যে হেতু ভারতের ভালমন্দ ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। চার্চিলের ঔপনিবেশিক শাসক-সুলভ ব্যক্তিত্ব বাংলার দুর্ভিক্ষকে কী ভাবে তীব্র, দীর্ঘমেয়ািদ করেছিল, মধুশ্রী তা দেখিয়েছেন।

সে প্রসঙ্গ জনমও টেনেছেন। তবে জনমের ঝোঁকটা কারণ খোঁজার দিকে ততটা নয়। বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশের প্রশাসন, বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতি, সংবাদ-নিয়ন্ত্রণ, গ্রাম বাংলা-নগর কলকাতার বিভাজন, এমন প্রতিটি বিষয় কী ভাবে একে অন্যকে প্রভাবিত করে আর্থিক-সামাজিক বিপর্যয় তৈরি করল, ধাপে ধাপে তা দেখিয়েছেন তিনি। প্রতিটা ধাপেই ধাক্কা খেতে হয়। ১৯৪২ সালে বাংলার গভর্নর হার্বার্ট ‘বাড়তি চাল’ জোর করে কিনে নেওয়ার নীতি নিলেন। অ্যাসেম্বলিতে হিন্দু নেতারা আপত্তি তুললেন, মুসলিম লিগের অনুগত লোককে কেন চাল কেনার দায়িত্ব দেওয়া হল? তাতে আরও চার জন দালাল নিয়োগ হল। একজন হিন্দু মহাসভার ঘনিষ্ঠ, একজন এক দলিত নেতার মনোনীত, একজন কংগ্রেসি মুসলিম। চতুর্থজন স্রেফ টাকা আর সংযোগের জোরে চাল কেনার বরাত জোটালেন। ১৯৪১ সালের শেষ থেকেই যেখানে চালের দাম চড়ছে, দ্রুত সেখানে কেন রফতানির জন্য চাল কেনা হবে, সে প্রশ্নে নেতারা কেউ সে দিন সরব হননি। জনাকতক চালের মজুতদার গোটা ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করছিল। নেতারা দালালদের কাছে মাথা বিকোলে মানুষের দশা কী হয়, তা মনে রাখতেও এ বই পড়া দরকার।

মন্বন্তরের ছবি কম নেই। কলকাতার ফুটপাথে মৃতদেহ, মৃত শিশু কোলে মা, লঙ্গরখানার লাইন, ডাস্টবিনে কুকুরে-মানুষে লড়াই। কিন্তু এ বই পড়লে মনে হয়, সে দিনের দুর্ভিক্ষের প্রতীক এক উন্মাদ। কলকাতার হাসপাতালে তাকে দেখেছিলেন বাংলার সার্জেন-জেনারেল। দেহ কঙ্কালসার, ক্ষয়া দাঁতের উপরে গুটিয়ে শুকনো ঠোঁট, গা-ময় ঘা। সামনে রাখা ভাত-তরকারির থালা। কিন্তু সে খাচ্ছে না, একটানা চেঁচিয়ে চলেছে। সাহেব ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন, ভাত চাইছে সে। সামনেই ভাত, তা বোঝার অবস্থা তার নেই।

এই মানুষ থেকে অ-মানুষ করে তোলার কাজটা না হলে কোনও বড় মাপের হিংসা সম্ভব হয় না, মনে করিয়ে দিচ্ছেন জনম। যুদ্ধ বা দাঙ্গা হতে পারে, যখন সামনের লোকগুলোকে বিকৃত, ভীতিপ্রদ, অশুচি বলে মনে হতে থাকে। জনম বলছেন, এই ‘ভিন্নতা’ তৈরিতে অনাহারের জুড়ি নেই। কিছু জ্যান্ত ভূত, খিদে-শোকে উন্মাদ, পড়ে গেলে উঠতে পারে না, ওগুলো কি মানুষ? ক্ষমতার আধিপত্য যত রকম হিংসা তৈরি করতে পারে, দুর্ভিক্ষ তার মধ্যে সব চাইতে ভয়ঙ্কর। দুর্ভিক্ষের মৃতদেহ থেকে দাঙ্গার মৃতদেহ, রাষ্ট্র দুটোকে কী ভাবে দেখেছে, তার বিবরণও রয়েছে।

এমন নিবিড় নিরীক্ষার ভিত্তিতে জনমের দাবি, কলকাতার দাঙ্গার ব্যাখ্যা করতে হলে দুর্ভিক্ষের কলকাতার দিকে তাকাতে হবে। কলকাতায় থাকার অধিকার যে সবার নেই, যার নেই তাকে যে জোর করে সরিয়ে দেওয়া চলে, এই বোধ তৈরি হয় দুর্ভিক্ষের সময়ে। দাঙ্গায় কয়েক হাজার পরিবারের শহরছাড়া হওয়া সেই অভিজ্ঞতার জের। দাঙ্গায় লুঠের মালের বড় অংশ উদ্ধার হয়েছিল বস্তিগুলো থেকে। কুলি, খালাসি, গোয়ালা, ঝাড়ুদার, মিস্ত্রিদের সেই সব বস্তি ছিল দুর্ভিক্ষ-অসুখের প্রধান শিকার। এ কথাগুলো বিবেচনা না করলে দাঙ্গার আর্থ-সামাজিক কারণগুলি চাপা পড়ে যায়। সুরঞ্জন দাসের মতো গবেষকরা প্রধানত রাজনীতি আর সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে দাঙ্গার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তা যথেষ্ট নয়।

জনমের তত্ত্ব বিতর্ক-সাপেক্ষ। ভারতে দাঙ্গার ইতিহাস দীর্ঘ ও বিচিত্র। অন্য সম্প্রদায়ের ‘অধিকার’ নিয়ে বিচার সেখানে কতটা প্রাধান্য পেতে পারে, তা হয়তো শুধু ঔপনিবেশিক কলকাতার ঘটনাক্রমের প্রেক্ষিতে বলা চলে না। তবে শেষ বিচারে তাঁর এমন সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা বা খণ্ডন এই বইটির মূল্য নির্ধারণ করবে না। এ বইয়ের নাম শিল্পী চিত্তপ্রসাদের দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত ছবির সংকলনের নামে। সে নামকরণ সার্থক। নথিপত্র, সংবাদ-স্মৃতি থেকে প্রতিটি তথ্য, উদ্ধৃতিকে জনম ব্যবহার করেছেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদের তুলি-কলমের আঁচড়ের মতো। মরা মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন