পুস্তক পরিচয় ২

অনুবাদে সমৃদ্ধ হল বাংলা সাহিত্য

বাঙালি পাঠক ইংরেজি তো বটেই, ফরাসি-রাশিয়ান-স্প্যানিশ ভাষায় যত অনুবাদ পড়েছে, নিজ দেশের অন্যান্য রাজ্যের তা পড়েনি— এ কথাটা দিনের আলোর মতো সত্য। আর তা মেনে নেওয়াই উচিত। বাংলা ভাষা বাদে আবার ভারতীয় অন্যান্য ভাষাতেও সাহিত্য হয়!— এমনই বিস্ময় এবং নাক উঁচু ধরনের অবস্থান নজরে পড়ে বাঙালি সাহিত্য‘রসিক’ মহলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

বাঙালি পাঠক ইংরেজি তো বটেই, ফরাসি-রাশিয়ান-স্প্যানিশ ভাষায় যত অনুবাদ পড়েছে, নিজ দেশের অন্যান্য রাজ্যের তা পড়েনি— এ কথাটা দিনের আলোর মতো সত্য। আর তা মেনে নেওয়াই উচিত। বাংলা ভাষা বাদে আবার ভারতীয় অন্যান্য ভাষাতেও সাহিত্য হয়!— এমনই বিস্ময় এবং নাক উঁচু ধরনের অবস্থান নজরে পড়ে বাঙালি সাহিত্য‘রসিক’ মহলে। তবে এরই মধ্যে সাহিত্য অকাদেমি নীরবে একটি প্রয়োজনীয় কাজ করে চলেছে— অন্যান্য ভাষার উল্লেখযোগ্য বইগুলির বঙ্গানুবাদ। শুধু অনুবাদই নয়, অনুবাদটিও যেন সাহিত্যতুল্যই থাকে, সেটিও তারা আতস কাচের নীচে রেখেছে।

Advertisement

আলোচ্য চারটি বইয়ের মধ্যে প্রথমেই আসে গোপীনাথ মহান্তির পরজা (অনু: ভারতী নন্দী)। গোপীনাথ মহান্তি-র শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। নতুন করে তাঁর পরিচয় লাগে না। তাঁর এই উপন্যাসটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা অনূদিত হয়ে পাশ্চাত্যেও পঠিত হয়েছে। পরজা জনজাতি ও কোরাপুট তালুকের গভীরে জঙ্গলের পাহাড়-নদী-ঝরনা-গাছপালা, সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মহাজনদের রক্তস্নাত সম্পর্ক— এ সব মিলিয়ে এক এপিক সৃষ্টি করেছিলেন। সর্বোপরি পরজাদের মুখের ভাষাতেই তিনি এ উপন্যাস বেঁধেছিলেন। শুধুমাত্র ওড়িয়া ভাষায় নয়, ভারতীয় সাহিত্যেও এ উপন্যাস মাইল ফলক। ভারতী নন্দী যথাসাধ্য পরিশ্রম করেছেন এই দুরূহ অনুবাদের পিছনে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ওড়িশার বহরমপুরে একটি বাংলা-ওড়িয়া অনুবাদ কর্মশালায় তিন দিন ধরে চেষ্টা করেও ‘ঘটেঘৃত’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ করা যায়নি। এমন শব্দ এ উপন্যাসে অজস্র। এখানেই ভারতী নন্দীর কৃতিত্ব। পরজা যেন সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই চরিত মানস মনে পড়ায়।

• পরজা, গোপীনাথ মহান্তি। ১৬০.০০

Advertisement

• তিরুক্কুরল, তিরুবল্লুবর। ১২০.০০

• হঠযোগী, তারা মীরচন্দানী। ৯০.০০

• যুগান্ত, মহেশ এলকুঞ্চওয়ার। ১২০.০০

দ্বিতীয়টি একটি কাব্যগ্রন্থ— তিরুক্কুরল। তামিল ভাষায় তিরুবল্লুবর রচিত এ কাব্যগ্রন্থ ভারতীয় সাহিত্যের এক আশ্চর্য সম্পদ। তিরু মানে শ্রী আর কুরল মানে ছোট। অর্থাৎ, স্বল্প কথায় গভীর ও নিহিত অর্থ পাঠককে দেওয়া। এর সঙ্গে চর্যাপদের একটা যেন সাদৃশ্য দেখা দেয়। ‘দিবসই বহুড়ি কারুই ভরে ভাঅ/ রাতি ভাইলে কামরু জাঅ’। সান্ধ্যভাষার এই দোলাচলও এ কাব্যগ্রন্থে রয়েছে, যেমন— ‘যে খায় অন্য জীবের দেহ নিজ শরীরপোষণে/ কেমনে স্থান পেতে পারে দয়া তার মনে?’ অথবা ‘যে সংযমশক্তিযুক্ত/ মৃত্যুও তার হাতে পরাভূত।’ তিরুবল্লুবর সম্পর্কে নানা লোককথা প্রচলিত রয়েছে। হিন্দু-শৈব-বৈষ্ণব-জৈন-বৌদ্ধ, সবাই দাবি করেন কবি তাঁদেরই ধর্মাবলম্বী। কারও মতে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মানুষ তিনি, কেউ বা বলেন পরবর্তী। দু’ হাজার বছরের ঐতিহ্য ও মহিমামণ্ডিত তামিল সাহিত্যে প্রথম পাঁচটি গ্রন্থের মধ্যে তিরুক্কুরল। এ গ্রন্থের অনুবাদক সুব্রহ্মণ্যম কৃষ্ণমূর্তি বহুভাষাবিদ। তাঁর বইটি তৃতীয় বঙ্গানুবাদ তিরুক্কুরল-এর। পড়তে পড়তে মনে হয়, এত স্বচ্ছন্দ বাংলা ভাষা গভীরতার সঙ্গে কৃষ্ণমূর্তি কী ভাবে আয়ত্ত করেছিলেন?

তৃতীয় গ্রন্থটি তারা মীরচন্দানী-র হঠযোগী। বাংলায় অনুবাদের আগেই এ উপন্যাস সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। এ এক পরিণতি না পাওয়া প্রেমের করুণ কাহিনি, যার বাস্তবভূমি স্বাধীনতাপূর্ব বারাণসী ও কলকাতা। অনুবাদক মায়া গরানীকে ধন্যবাদ, কেননা সিন্ধি ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে বাংলা ভাষায় জানতে পারা দুরূহ ব্যাপার। যদিও উল ঝরল তনু রেশমজু খুবই বিখ্যাত ছোটগল্প সংকলন। তবু সিন্ধি-সাহিত্যের অনুবাদ খুবই কম। মায়া গরানীর বাংলাও অতি মনোরম। তিনি বাংলা ভাষার পাঠকের সঙ্গে সিন্ধি ভাষার যোগাযোগ করিয়ে কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে রইলেন।

চতুর্থ গ্রন্থটি যুগান্ত। লেখক মহেশ এলকুঞ্চওয়ার। এটি একটি মরাঠি নাটক। লেখক একজন প্রসিদ্ধ নাট্যকার। তাঁর ‘হোলি’ অতি বিখ্যাত নাটক। যুগান্ত প্রায় আট-নয় ঘণ্টার নাটক। বস্তুত তিনটি নাটক নিয়ে নাট্য-শরীর। নীতা সেন সমর্থ চমৎকার অনুবাদ করেছেন। একদা ধনী এক পরিবার, যাদের পাথরের সুবিশাল বাংলো রয়েছে, তাকে ঘিরেই কয়েক প্রজন্মের নাটকের গতিবিধি। ভারতীয় নাটকে ‘যুগান্ত’ উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি অনুবাদ হওয়ায় বাংলা নাটকও সমৃদ্ধ হল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement