‘দ্বিতীয় ঠান্ডা লড়াই’য়ে চিনের কাছে হারতে চলেছে আমেরিকা? যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল’ বা এনএসএস (ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি) রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই এই ইস্যুতে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। বেজিংকে হালকা ভাবে নিলে আগামী দিনে ওয়াশিংটনকে পস্তাতে হবে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। কারণ, এ বার আর মতাদর্শগত সংঘাত নয়। ড্রাগনের আর্থিক ‘শক্তিশেলের’ আঘাত সইতে হবে প্রশান্ত ও আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’কে।
চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল’ বা এনএসএস (ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি) সংক্রান্ত ২৯ পাতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দফতরের (ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার) সদর কার্যালয় পেন্টাগনের তৈরি ওই নথির ছত্রে ছত্রে রয়েছে চিনকে নিয়ে সতর্কতা। বেজিঙের থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে আমেরিকা পিছিয়ে আছে, তা-ও সেখানে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দ্রুত সেই সব ফাঁকফোকর বুজিয়ে না ফেললে ওয়াশিংটনের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, বলছে বিশেষজ্ঞমহল।
এনএসএস রিপোর্ট অনুযায়ী, আগামী দিনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ বা তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি সংঘাতে জড়াবে যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতি যে সে দিকে গড়াচ্ছে, ইতিমধ্যেই তা বুঝে গিয়েছে বেজিং। সেইমতো প্রস্তুতিও নিতে শুরু করে দিয়েছে তারা। আর তাই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের বদলে দু’হাজার বছরের প্রাচীন চৈনিক সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন মান্দারিনভাষীরা। তুলে ধরা হচ্ছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কথা।
১৯৪৫ সালে শুরু হওয়া ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর প্রথম পর্যায়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট মতাদর্শে আতঙ্কিত ছিল আমেরিকা। কৃষি, শিল্প, প্রতিরক্ষা এবং মহাকাশ গবেষণায় মস্কোর উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধ্বংসের কারণ হবে বলে মনে করেছিল ওয়াশিংটন। সেই ভয় থেকেই ১৯৪৯ সালে মার্কিন নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গড়ে তোলে পশ্চিম ইউরোপ। নাম, ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। বর্তমানে এতে রয়েছে মোট ৩২টি দেশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী (১৯৩৯-’৪৫) সময়ে নেটো গঠনকে মার্কিন বিদেশনীতির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলা যেতে পারে। বিশ্লেষকদের দাবি, এর থেকে দ্বিমুখী লাভ পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি এবং ইটালির মতো উন্নত দেশগুলির অর্থনীতিকে একরকম কব্জা করে ফেলে ওয়াশিংটন। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ জুড়ে গড়ে ওঠে আমেরিকার সামরিক ছাউনি। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিকে তাদের তৈরি হাতিয়ার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কিনতে একরকম বাধ্য করতে থাকে আমেরিকা।
কিন্তু, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্রুত বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। ওই ঘটনার জেরে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সোভিয়েত ভেঙে রাশিয়া-সহ ১৫টি দেশ তৈরি হলেও নেটোর অস্তিত্ব বিলোপ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। উল্টে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের ভয় দেখিয়ে মস্কোর দরজা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটের বিস্তার ঘটাতে থাকে তারা।
সোভিয়েত পতনের পর বিশ্বের শক্তির ভরকেন্দ্র পুরোপুরি ঝুঁকে যায় ওয়াশিংটনের দিকে। বিশ্লেষকদের দাবি, ঠিক এই সময়ই দু’টি বড় ভুল করে বসে যুক্তরাষ্ট্র, যার প্রথমটা ছিল নেটোর বিস্তার। এর জেরে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, এস্টোনিয়া বা ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলিও পেয়ে যায় সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটের সদস্যপদ। দ্বিতীয়ত, ডলারকে সামনে রেখে নিষেধাজ্ঞাভিত্তিক অর্থনীতি চালাতে থাকেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। এতে ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে ঘরোয়া উৎপাদন।
নেটোর বিস্তারে আমেরিকার সামরিক খাতে খরচ বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অন্য দিকে, প্রতিরক্ষা খাতে নামমাত্র খরচ করে মার্কিন পরমাণু হাতিয়ারের ছাতার তলায় চলে যায় ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। ঠিক এই সময় আসরে নামে চিন। ব্যাপক সস্তায় যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিকে শিল্পসামগ্রী তৈরি করে দেওয়ার ‘মেগা অফার’ দেয় বেজিং। ড্রাগনের সেই টোপ গিলতে ওয়াশিংটন এবং তাঁর ‘বন্ধু’রা বেশি দেরি করেনি।
২০০১ সালে ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ বা ডব্লিউটিও-র (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন) সদস্যপদ পায় চিন। এর পরই দুনিয়ার যাবতীয় পণ্যের কারখানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বেজিং। পরবর্তী দশকগুলিতে পরিবেশ রক্ষার কথা বলে গাড়ি থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের মতো যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদনকেন্দ্রকে ড্রাগনভূমিতে সরিয়ে ফেলে আমেরিকা-সহ গোটা পশ্চিমি দুনিয়া। একে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের আর্থিক পতনের সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
সোভিয়েতের সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলাকালীন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ-র মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি ওয়াশিংটনের ইচ্ছাপূরণের পর চুপ করে বসে থাকেনি। সুযোগ বুঝে মার্কিন শহরকেও নিশানা করেছে তারা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল ৯/১১-র হামলা, যে দিন নিউ ইয়র্কের জোড়া বহুতলে আছড়ে পড়েছিল ‘আল কায়দা’র ছিনতাই করা বিমান।
পূর্ব ইউরোপের দিকে নেটোর বিস্তার একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি রাশিয়া। মস্কোর কুর্সিতে বসার পর এই নিয়ে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বকে বার বার সতর্ক করেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর কথা গায়ে মাখেনি কেউ। কয়েক বছরের মধ্যেই আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ক্রেমলিন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে রুশ ফৌজ। গত পৌনে চার বছর ধরে চলছে সেই যুদ্ধ। এতে প্রশ্নের মুখে পড়ে ‘মার্কিন সুরক্ষা’র গ্যারান্টি।
ওয়াশিংটনের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল’ নথি অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন মোর্চায় চক্রব্যূহের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা। প্রথমত, ইউরোপে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে হলে মস্কোর সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে জড়াতে হবে ওয়াশিংটনকে। সে ক্ষেত্রে অন্যের লড়াইয়ের বোঝা এসে চাপবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে, যার যাবতীয় খরচ জোগাতে হবে মার্কিন সরকারকেই। পাশাপাশি থাকছে ক্রেমলিনের পরমাণু হামলার আশঙ্কাও।
দ্বিতীয়ত, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া আমেরিকার পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কারণ, ড্রাগনভূমিতেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার পণ্য উৎপাদনের কারখানা। লড়াইয়ের সময় সেগুলির ক্ষতি হলে সমস্যায় পড়তে পারে মার্কিন অর্থনীতি। তা ছাড়া সামরিক শক্তির দিক থেকে একেবারেই পিছিয়ে নেই বেজিং।
বর্তমানে চিনের হাতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী। সাবেক সেনাকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, ড্রোন, কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এবং সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে ওয়াশিংটনের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে আছে বেজিং। ফলে যুদ্ধের সময় কম খরচে মার্কিন ফৌজের অনেকটাই বেশি আর্থিক লোকসান করানোর সক্ষমতা আছে ড্রাগনের। লড়াইয়ে নামার আগে এটাও মাথায় রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডারদের।
এ ছাড়া মহাকাশের লড়াইয়েও আমেরিকাকে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে চিন। পৃথিবীর নিম্নকক্ষে নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বেজিং। অন্য দিকে, এই ধরনের সম্পূর্ণ নিজস্ব কোনও মহাকাশ স্টেশন নেই ওয়াশিংটনের। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) অস্ত্র বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা পিছিয়ে আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
আমেরিকার আর একটি বড় হাতিয়ার হল ডলার। বর্তমানে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। মার্কিন মুদ্রার সেই একাধিপত্য ভাঙতে উদ্যোগী হয়েছে রাশিয়া। ‘ব্রিকস’-ভুক্ত দেশগুলির জন্য একটি পৃথক মুদ্রা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন পুতিন। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির সদস্যপদ রয়েছে ভারত, চিন এবং ব্রাজ়িলের মতো বড় বড় দ্রুত বর্ধনশীল আর্থিক রাষ্ট্রের। ফলে ব্রিকস মুদ্রা বাজারে এলে ডলারের দাম খাদে নেমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে বিরল খনিজকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে চিন। এর উপর বেজিঙের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলা যেতে পারে। ড্রাগন অর্থনীতির সূচকে লাগাম টানতে এ বছর শুল্কযুদ্ধে নামেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাতে কোনও লাভই হয়নি। উল্টে এক লক্ষ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত রফতানি করতে পেরেছে বেজিং।
আমেরিকা যখন ‘বন্ধু’ বাড়াতে শুধুই সামরিক খাতে লগ্নি করেছে, তখন ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর পরিকাঠামোগত উন্নয়ন মডেল নিয়ে আর্থিক সমৃদ্ধির রাস্তায় হেঁটেছে বেজিং। ফলে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে দেরি করেনি ফ্রান্সের মতো দেশও। তা ছাড়া বার বার নীতিবদলের জেরে ভারতের মতো কৌশলগত অংশীদারের পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে।
এনএসএস-এ বলা হয়েছে, নিজের মতো করে আঞ্চলিক জোট তৈরি করে নিয়েছে চিন। বেজিঙের পাশে আছে রাশিয়া এবং ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে (উত্তর কোরিয়া)। এ ছাড়া ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সংঘাত পরিস্থিতিতে নিশ্চুপ থাকতে পারে ভারত। আর তাই বেজিঙের শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের ভরসা জেতার দিকে সরকারকে নজর দিতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর ধাক্কা আমেরিকা কী ভাবে সামলায়, সেটাই এখন দেখার।