পুস্তক পরিচয় ২

তৃতীয় জীবনের কথা জানতে ইচ্ছে করে

মনোহরমৌলি বিশ্বাসের তিনটি জীবন। দুটির কথা তাঁর আত্মকথনের এই অনুবাদে মিলবে। তৃতীয় জীবনের কথা কেবল কয়েক বার ছুঁয়ে গিয়েছেন তিনি।

Advertisement

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

সারভাইভিং ইন মাই ওয়ার্লড/ গ্রোইং আপ দলিত ইন বেঙ্গল, মনোহরমৌলি বিশ্বাস। অনুবাদ ও সম্পাদনা: অঙ্গনা দত্ত ও জয়দীপ ষড়ঙ্গী। সাম্য, ৩৫০.০০

মনোহরমৌলি বিশ্বাসের তিনটি জীবন। দুটির কথা তাঁর আত্মকথনের এই অনুবাদে মিলবে। তৃতীয় জীবনের কথা কেবল কয়েক বার ছুঁয়ে গিয়েছেন তিনি।

Advertisement

শৈশবে এবং কৈশোরে উনি ছিলেন হারাধন বিশ্বাসের নাতি। থাকতেন মেটের গাতি গ্রামে, খড়ের ঘরে। সেখানে মাটির দাওয়া। সেখানে বসে ওঁর বাবা স্বপ্ন দেখতেন ছেলেমেয়েরা কেবল লেখাপড়া শিখবে আর বড় হয়ে কেউকেটা হবে। বাবার ইচ্ছেতেই লেখাপড়া শুরু মনোহরমৌলির। গ্রামে আগে পাঠশালা ছিল না। মনোহরের জন্মের কয়েক বছর আগে কজন গ্রামবাসীর উদ্যোগে একটা পাঠশালা খোলা হয়। সেই পাঠশালাতেই পাঠ শুরু মনোহরের। পাঠশালা শেষ করে চার মাইল দূরের স্কুলে ভর্তি হওয়া। তারপর যশোর-খুলনা রেঞ্জের মধ্যে বৃত্তি পরীক্ষায় এক নম্বর। গ্রামে ধন্য ধন্য রব। চাষার ব্যাটা বাবুদের খোকাদের হারিয়ে দিয়েছিল যে।

নিম্নবিত্ত চাষি পরিবার। তাই চাষের কাজে মনোহরকে লেখাপড়ার চেয়ে অনেক বেশি সময় দিতে হত। এই সময়ের আরও দুটো ঘটনা স্পষ্ট মনে পড়ে মনোহরের। একবার অমূল্য মাস্টার পিঠে বেত মেরেছিলেন। তারপর রেগে আগুন হয়ে মনোহরের জ্যাঠা মাস্টারকে কেটে ফেলবেন বলে কাটারি নিয়ে তাড়া করেছিলেন। অনেক কষ্টে গ্রামের বড়রা তাঁকে নিরস্ত করেন। আর মনে পড়ে অনেকে ‘শোর খাওয়া নমো’ বলে বিদ্রুপ করত। কেন না সেই সময় নমঃশূদ্র জাতির মধ্যে শুয়োরের মাংস খাওয়ার চল ছিল। প্রসঙ্গত, সেই সময় নমঃশূদ্র জাতির আত্মসত্তা নির্মাণের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

Advertisement

চাষই নমঃশূদ্রদের ধর্ম ছিল। সেই কারণে হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ধর্ম তাদের বিশেষ আকর্ষণ করত। আবার মনোহরের বাড়িতে কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিতের আনাগোনাও ছিল নিয়মিত। পুরোহিতরা আসতেন দূরের কোনও গ্রাম থেকে। তবে সহজে কোনও পুরোহিত ‘নম’দের বাড়ি পুজো করতে রাজি হতেন না। কেন না ‘নম’দের বাড়ি পুজো করলে পুজাির ব্রাহ্মণকে লোকে ‘চাঁড়ালের বাউন’ বলে অশ্রদ্ধা করত।

গোদাঁড়া (এক অর্থে সীমানা, অন্য অর্থে বাঁধ) ছিল মনোহরদের হৃত্স্পন্দন। বাহান্নখানা গ্রাম নিয়ে তৈরি হত একেকটা গোদাঁড়া। একটি গোদাঁড়ার সমস্ত বাসিন্দাই যে নমঃশূদ্র এমন নয়। কিন্তু তাদের একটা মিল ছিল; তারা প্রত্যেকেই পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর। গোদাঁড়ার বিভিন্ন কাজে লাগানো হত স্কুলছাত্রদেরও।

গণিতে লেটার মার্কস পেয়ে ম্যাট্রিক পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়া। তত দিনে অজানা পৃথিবীর অজস্র জানার বিষয় মনোহরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। হাতের কাছে বই পেলেই তা শেষ করা চাই।

স্বাধীনতার আগেই মনোহরদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে মূলঘর গ্রামে একটা লাইব্রেরি ছিল। রাস্তায় বিদ্যুৎ সংযোগও ছিল। দোতলা বাড়ি, হাইস্কুলও ছিল। কিন্তু মনোহরদের অঞ্চলের দুয়েকজন ছাড়া কেউ সেখানে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি। এই ব্যাপারটা তখন এবং পরেও ভাবায় মনোহরকে। নিজের জাতিগোষ্ঠী নিয়ে একটা গর্ববোধ সব সময় কাজ করে মনোহরের মনে। সেই কারণেই অরুন্ধতী রায়ের গড অব স্মল থিংস-এর কাঠের মিস্ত্রি ভেলুথা মনোহরের অন্যতম প্রিয় একটি চরিত্র।

জলৌকার (জোঁক) গায়ে নুন ছিটিয়ে দিতে বাধ্য হতেন মনোহর। কেননা সাপ আর জোঁকের সঙ্গে লড়াই ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। আজও সে কথা মনে প়ড়ে মনোহরের। যেমন মনে পড়ে ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু কালক্রমে হয়ে গিয়েছেন টেলি-কমিউনিকেশনস্ ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। লেখালেখির শুরু স্কুল থেকেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ১৯৬৭ সালে। কিন্তু স্বজাতির অবহেলা দেখে বারে বারে তাঁর মন কেঁদেছে। দলিত সাহিত্য ও প্রবন্ধ নিয়ে কাজ করা শুরু সেই তাড়নায়।

দলিত সংস্কৃতি আন্দোলন আজও সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন মনোহর। চালিয়ে যাবেনও।

এই হল মনোহরের দুই জীবন। এদের কথা বইখানিতে বিস্তারিত রয়েছে। কিন্তু তৃতীয় জীবনে মনোহর একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ নাতি এঁদের নিয়ে তাঁর সুখী পরিবার। এই জীবনের কথা বইতে তেমন নেই। যাঁরা তাঁর সানন্দ আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা এই তৃতীয় জীবনের কথাও জানেন। সেই বাড়িতে আছেন সক্রেটিস, প্লেটো, মার্ক্স্ এবং ল্যাংস্টন হিউজ, সকলেই অনুবাদে।

অবশ্য সেখানেও সকলের আগে আছেন অম্বেডকর। এই তৃতীয় জীবনও অতি মনোহর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন