পুস্তক পরিচয় ২

তাৎপর্যহীন পুতুলনাচের ইতিকথা

পনেরো বছর পর মিলান কুন্দেরা ফের তাঁর মেধাবী শয়তানিতে আমাদের চমৎকৃত করলেন। কুন্দেরা তো পাঠককে নিছক মুগ্ধ করেন না। রসিকতা, যৌনতা, দার্শনিকতা এবং ইতিহাসের পিচ্ছিল পথে নিয়ে যেতে যেতে একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। আর আমরা চমকে উঠি। এটাই তা হলে বেঁচে থাকা?

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share:

পনেরো বছর পর মিলান কুন্দেরা ফের তাঁর মেধাবী শয়তানিতে আমাদের চমৎকৃত করলেন। কুন্দেরা তো পাঠককে নিছক মুগ্ধ করেন না। রসিকতা, যৌনতা, দার্শনিকতা এবং ইতিহাসের পিচ্ছিল পথে নিয়ে যেতে যেতে একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। আর আমরা চমকে উঠি। এটাই তা হলে বেঁচে থাকা? ‘ফ্লার্ট মানে সহবাসের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু গ্যারান্টি নেই। ভালবাসা অন্য জিনিস। নিজের যে অংশটা হারিয়ে আমি অপূর্ণ রয়ে গেলাম, তাকে খোঁজা। তাই সহবাস, রতিক্রীড়া অনেকের সঙ্গেই হয়। কিন্তু পাশাপাশি দুই নারী পুরুষ যখন নগ্ন হয়েও আশ্লেষে আবদ্ধ থাকে না, সেটাই ভালবাসা,’ আশির দশকেই জানিয়েছিল তাঁর উপন্যাস দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং-এর এক চরিত্র। ঘড়ায় তোলা জল বনাম দিঘির জলের শতাব্দীপ্রাচীন উপমা আর যার জন্য হোক, কুন্দেরা-পাঠকের জন্য নয়।

Advertisement

দ্য ফেস্টিভ্যাল অব ইনসিগনিফিক্যান্স, মিলান কুন্দেরা।
অনুবাদ: লিন্ডা অ্যাশার। ফেবার অ্যান্ড ফেবার, ৭৫০.০০

পনেরো বছর পর কুন্দেরার নতুন উপন্যাস। আয়তনে মাত্র ১১৪ পৃষ্ঠা। তাঁর আগের তিনটি উপন্যাসের মতো এটিও ফরাসি ভাষায় লেখা, ইংরেজিতে সদ্য অনূদিত। চুরাশি বছর বয়সি লেখকের উপন্যাস জানাচ্ছে, ‘আমরা তো বহুদিন ধরেই জানি, দুনিয়াটা বদলানো যাবে না। নতুন ভাবে গড়া যাবে না। প্রতিরোধের রাস্তা একটাই। কোনও কিছু সিরিয়াসলি না নেওয়া, সব কিছু নিয়ে তামাশা করা।’ তখনই মনে পড়ে যায় ষাটের দশকে কুন্দেরার প্রথম উপন্যাস দ্য জোক। নায়ক সেখানে চেক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লুদভিক। প্রেমিকার সিরিয়াস হাবভাব কাটাতে সে চিঠিতে লেখে, ‘আশাবাদ মানুষের আফিং। প্রশ্নহীন উজ্জ্বল পরিবেশ আসলে নির্বুদ্ধিতার গন্ধে ভরা। অতএব ট্রটস্কি জিন্দাবাদ।’ তার পরই লুদভিক পার্টি ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত। তার পর ইউরোপে বহু জল বয়ে গিয়েছে, কুন্দেরা দেশ ছেড়ে গত পঁচিশ বছর প্যারিসের বাসিন্দা। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত জমানা তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছে, সাবেক চেকোস্লোভাকিয়া দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত। তবু কুন্দেরা আজও রসিকতার প্রাণোচ্ছল বিদ্রোহ ও শক্তিমত্তার কথা বলেন। নতুন উপন্যাসে যেমন বলেছেন জীবনের অর্থহীনতা ও তাৎপর্যহীনতার কথা। উপন্যাসের শেষে রামোন বলে, ‘তাৎপর্যহীনতাই হল অস্তিত্বের মূল কথা। তাৎপর্যহীনতাই আমাদের সর্বক্ষণ, সর্বত্র ঘিরে রাখে। ইন্ডিভিজুয়ালিটি বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নেই, সবই তাৎপর্যহীন মরীচিকামাত্র।’ আর নায়কনায়িকাদের আড়াল থেকে লেখক আচমকা মুচকি হেসে অন্তরটিপুনি দিয়ে জানান, ‘বাপু হে, তোমার-আমার জীবনটাই তাৎপর্যহীনতার উৎসব।’

Advertisement

সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত ছোট্ট উপন্যাস। পাঁচ বন্ধু। আলাঁ শিল্পী। রামোন সম্প্রতি অবসর নিয়েছে। আছে ক্যালিবান, ডি আর্ডেলো আর চার্লস। সকলেই প্রৌঢ় কিংবা মাঝবয়সি। উপন্যাসের শুরুতে লুক্সেমবুর্গ পার্ক বেয়ে হেঁটে যায় আলাঁ। চার দিকে ছোট টপ পরা মেয়ে, তাদের নাভি দেখা যায়। কোনও সভ্যতায় পুরুষ লুকিয়েচুরিয়ে মেয়েদের ঊরু দেখত, কখনও দেখত বুক, আজ নাভি। আলাঁ উপলব্ধি করে, এই সভ্যতা পুরো মেয়েটিকে দেখে না। শুধু নাভিদর্শন করে। কিছু দূর এগোনোর পর উপন্যাস জানায়, ছেলেবেলায় আলাঁর মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই মায়ের সঙ্গে আজও মনে মনে কথা বলে আলাঁ, মা এক দিন তাকে মনে মনে কথা বলে নাভিরহস্য জানায়, পৃথিবীর প্রথম ছেলেটি ইভের নাভি থেকে জন্মেছে। তার পর একে একে অনেক মা, অনেক সন্তান। নাভি থেকেই যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে অজস্র মানুষের জঙ্গল, অজস্র স্মৃতি। এক দিন এই বৃক্ষ ভেঙে পড়বে, মানুষ তার সমস্ত অতীত এবং ভবিষ্যৎ, বুদ্ধ এবং নেপোলিয়ন সবাইকে নিয়ে হারিয়ে যাবে। লুপ্ত হবে না, শুধু হারিয়ে যাবে। প্লটহীন উপন্যাসে কুন্দেরা আজও এ ভাবেই বেঠোভেনের মূর্চ্ছনা তৈরি করেন। নিতসে থেকে ফ্রয়েড, কাফকা সকলের কথা মনে পড়িয়ে দেন।

উপন্যাসে এসেছে স্তালিনের কথা। স্তালিন একটা রসিকতা করতেন। তিনি শিকারে বেরিয়েছেন, গাছে ২৪টা পাখি। বন্দুকে ১২টা গুলি। ১২টা পাখি মেরে লৌহমানব ফিরে গেলেন, ফের টোটা ভরে নিয়ে এলেন। এ বার বাকি ১২টাও খতম। সকলে চুপ করে শুনতেন, ক্রুশ্চেভ প্রস্রাবাগারে গিয়ে অন্য কমরেডদের সামনে রাগে ফেটে পড়তেন, ‘উনি মিথ্যে বলছেন।’ উপন্যাসের শেষে স্তালিন ফের বন্দুক নিয়ে আসেন, লুক্সেমবুর্গ পার্কে তিনি বন্দুকের গুলিতে মেরি দ্য মেদিচির মূর্তি ভেঙে দেন। প্রৌঢ় আলাঁর প্রেমিকার বয়স কুড়ি, সে স্তালিনের নাম শোনেনি।

কিন্তু তা বলে কি এক প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের হবে না যোগাযোগ? লেখক জানান, মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হয় ঠিকই। কিন্তু প্রত্যেকে নিজস্ব অবজার্ভেশন পোস্টে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর এক দিন মৃত্যু আসে। তখন এরা বেশ কিছু দিন পরিচিতদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে। তারপর পরিচিতরাও আর থাকে না, শুধু মৃতের নামটা রয়ে যায়। মানুষটা কেমন, তার সাক্ষী থাকে না। সে তখন শুধু মৃত নয়। পুরনো মৃত, নিছকই পুতুলনাচের চরিত্র। বাঙালি পাঠককে বৃদ্ধ চেক লেখক ফের মনে পড়িয়ে দিলেন, জীবন মানেই তাৎপর্যহীন পুতুলনাচের ইতিকথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement