চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

ফুটে ওঠে পঞ্চাশ বছরের বাংলার শিল্পচেতনা

আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। ৫০ বছরে বাংলার শিল্পচেতনার বিবর্তনধারার কিছুটা আভাস উঠে আসে এই প্রদর্শনী থেকে। মুগ্ধ করেছেন অমলনাথ চাকলাদার টেম্পারায় আঁকা তাঁর ১১টি ছবি দিয়ে। আধুনিকতার সূচনাপর্বে এর বিপরীত প্রান্তে চর্চিত হচ্ছিল অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ক্যালকাটা পেইন্টার্স সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে পদার্পণ করল। ১৯৬৪ থেকে ২০১৪ ৫০ বছর ধরে সৃজনের পথ পরিক্রমা করেছেন এই দলের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা। ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী ভারতের আধুনিকতাবাদী শিল্পধারায় তাঁদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন। পুরনো কেউ কেউ দল ছেড়েছেন। মৃত্যুতে বা অন্য কোনও কারণে। যোগ দিয়েছেন নবীন প্রজন্মের তরুণ শিল্পী। প্রবীণ নবীন মিলিয়ে দলের সদস্য ২৫ জন চিত্রী ভাস্করের কাজ নিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি আইসিসিআর-এর দু’টি গ্যালারি জুড়ে। প্রয়াত চার জন শিল্পী যাঁরা ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদের ছবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রদর্শনীতে। শিল্পীরা হলেন মহিমরঞ্জন রুদ্র, নিখিল বিশ্বাস, বিজন চৌধুরী ও গোপাল সান্যাল।

Advertisement

৫০ বছরে বাংলার শিল্পচেতনার বিবর্তনধারার কিছুটা আভাস উঠে আসে এই প্রদর্শনী থেকে। মুগ্ধ করেছেন অমলনাথ চাকলাদার টেম্পারায় আঁকা তাঁর ১১টি ছবি দিয়ে। আধুনিকতার সূচনাপর্বে এর বিপরীত প্রান্তে চর্চিত হচ্ছিল অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতা। সেই আঙ্গিক এখনও যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বোঝা যায় এই প্রদর্শনীতে ওয়াসিম কপূরের (১৯৫১) তেলরঙে আঁকা অসামান্য দু’টি নগ্নিকা-রূপাবয়ব দেখে। নারীর শরীরী সংবেদনের মধ্যেও তিনি নিহিত রাখতে পেরেছেন মগ্ন সৌন্দর্য।

এই প্রদর্শনীতে ভাস্কর ছিলেন তিন জন। বিপিন গোস্বামীর ১৩টি ব্রোঞ্জ লৌকিকের সঙ্গে অভিব্যক্তিবাদী রূপরীতিকে সমন্বিত করে বাস্তবতার নানা দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে তোলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সুরজিৎ দাসের ছিল মার্বেল, ব্রোঞ্জ ও প্লাস্টারের ৬টি ভাস্কর্য। নেহরু বা রামকৃষ্ণের মুখাবয়বে স্বাভাবিকতার ভিতরেও সূক্ষ্ম এক অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা এনেছেন তিনি। অপেক্ষাকৃত তরুণ ভাস্কর প্রদীপ মণ্ডল ধাতু ছাড়াও কাচ ও মিশ্রমাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন তাঁর ১৩টি রচনায়।

Advertisement

শিল্পী: তপন ঘোষ।

রবীন মণ্ডলের আদিমতা-সঞ্জাত অন্তর্দীপ্ত অভিব্যক্তিবাদী সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত ‘ডিটি’ শীর্ষক তেল ও অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসটি। দেবমূর্তিকে তিনি যিশুর আত্মত্যাগের করুণার সঙ্গে মিলিয়েছেন। প্রকাশ কর্মকারের একটিই মাত্র বড় মাপের নিসর্গরচনায় তাঁর সারা জীবনের ‘ক্ষয়ের’ দর্শন সুপ্ত হয়ে আছে। নিসর্গ নিয়ে ভিন্ন মাত্রায় কাজ করেছেন তপন ঘোষ। ‘ড্রিমস্কেপ’ শীর্ষক চারটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে চিত্রক্ষেত্রের জ্যামিতিক বিন্যাসের সঙ্গে স্বাভাবিকতাকে কল্পরূপে অভিষিক্ত করেছেন। নিসর্গকেই নিজস্ব ভাষায় বিমূর্তায়িত করেছেন অনিতা রায়চৌধুরী ও শ্যামশ্রী বসু।

এই প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম অনিমেষ নন্দীর তেলরঙের তিনটি ক্যানভাস। ১৯৬০-এর প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে এই প্রদর্শনীতে আরও ছিলেন ঈশা মহম্মদ, নিখিলেশ দাস, ফাল্গুনী দাশগুপ্ত, বরুণ রায়, যোগেন চৌধুরী, নীরেন সেনগুপ্ত ও ধীরাজ চৌধুরী। ঈশা মহম্মদ তেলরঙ ও অ্যাক্রিলিকে স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে এঁকেছেন তিনটি ক্যানভাস। ‘এপ্তার-রমজান’ ও ‘কর্ণ-কুন্তি’ শীর্ষক দুটি রচনায় তিনি দুই সম্প্রদায়ের পুরাণকল্পের উপর আলো ফেলেছেন। যোগেন চৌধুরী মিশ্রমাধ্যমের সাতটি অনামা ছোট রচনায় প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গকে উদ্ভাসিত করেছেন তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে।

দেবব্রত চক্রবর্তীর সাতটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসের মধ্যে ছ’টি ‘ওয়ারিয়র সিরিজ’-এর অন্তর্গত। একটির শিরোনাম ‘ড্রিমস্কেপ’। দ্বিজেন গুপ্ত তাঁর তিনটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে বৃক্ষকে মানবীচেতনায় সম্পৃক্ত করেছেন।

গৌতম ভৌমিক স্থূল বর্ণবুনোটে তেলরং ও অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন ‘মিউজিশিয়ান’ শীর্ষক তিনটি ছবি। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র থেকে তাঁর নিজস্ব শৈলী তৈরি করেছেন। সুশান্ত চক্রবর্তী অ্যাক্রিলিকের পাঁচটি রচনায় অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা দিয়ে বাস্তবের অন্তর্লীন সংঘাতকে ধরতে চেয়েছেন। সুব্রত ঘোষ আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রচলিত রূপরীতির বাইরে যেতে চেষ্টা করেছেন। ক্যানভাসে অনেকটা পরিসর শূন্য রেখে বিচ্ছিন্ন ভাবে ড্রয়িং করেছেন। শুভব্রত নন্দী দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন শহরের অট্টালিকা নির্মাণের বিমানবিক পরিমণ্ডল নিয়ে। চারটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসেও সেই কালিমাকেই তিনি কশাঘাত করতে চেয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন