চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

মাটির স্পর্শে জেগে ওঠে মানুষের শিল্পীসত্তা

মায়া আর্ট স্পেসে অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষমানুষের শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে মৃত্তিকার সম্পর্ক সেই নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে প্রবাহিত হয়ে এসেছে। মাটিই মানুষকে ধারণ করে, বাঁচিয়ে রাখে, ফসল ফলায়। মাটির স্পর্শে তাই জেগে ওঠে মানুষের শিল্পীসত্তা। মৃত্তিকা-ভিত্তিক শিল্পের নানা প্রকারভেদ আছে। যেমন টেরাকোটা, পোর্সেলেন, আর্থেনওয়্যার, স্টোনওয়্যার, সেরামিকস ইত্যাদি। সবগুলিই গড়ে ওঠে মাটি, আগুন, জল ও বাতাস এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share:

মানুষের শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে মৃত্তিকার সম্পর্ক সেই নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে প্রবাহিত হয়ে এসেছে। মাটিই মানুষকে ধারণ করে, বাঁচিয়ে রাখে, ফসল ফলায়। মাটির স্পর্শে তাই জেগে ওঠে মানুষের শিল্পীসত্তা। মৃত্তিকা-ভিত্তিক শিল্পের নানা প্রকারভেদ আছে। যেমন টেরাকোটা, পোর্সেলেন, আর্থেনওয়্যার, স্টোনওয়্যার, সেরামিকস ইত্যাদি। সবগুলিই গড়ে ওঠে মাটি, আগুন, জল ও বাতাস এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে। আমাদের সমকালীন ভাস্কর্যে টেরাকোটা যত বেশি প্রচলিত, সেরামিকস ততটা নয়। কিন্তু টেরাকোটার থেকে অনেক উচ্চ তাপে রূপান্তরিত এই মাধ্যমের রয়েছে নিজস্ব নান্দনিক বৈভব, এর কঠিনতায় ও গ্লেজ বা আলোক-বিচ্ছুরণ ক্ষমতায়। ইদানীং অনেক তরুণ শিল্পী আকৃষ্ট হচ্ছেন সেরামিকসের প্রতি। পশ্চিমবঙ্গের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মাধ্যমে সমৃদ্ধ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এখন। সে দুটি হল কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ ও শান্তিনিকেতনের কলাভবন।

Advertisement

মায়া আর্ট স্পেসে এরকমই তরুণ শিল্পীদের সেরামিকস-শিল্প নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সমৃদ্ধ প্রদর্শনী। ১২ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছেন বিশিষ্ট চিক্রী ও সেরামিকস-শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত। প্রদর্শনীটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছে শিল্পীদের ভাবনা ও প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্বে। নিছক বর্ণনাত্মক ও সাধারণ অবয়বী রূপকল্পকে ছাড়িয়ে শিল্পীরা রূপের নানা বৈচিত্র অন্বেষণ করেছেন। প্রকরণ বৈচিত্রে সেরামিকসের অন্য দুটি পদ্ধতি আর্থেনওয়্যার ও স্টোনওয়্যার-ও সমৃদ্ধভাবে ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মার্ক অন ক্লে’।

অনিত্য রায় তাঁর আটটি রচনায় বাস্তবকে কল্পমায়ায় রূপান্তরিত করে করুণাদীর্ণ গভীর বোধকে উৎসারিত করেছেন। তাঁর স্টোনওয়্যার ‘মৎস্য কন্যা’ এক মানবী ও মৎস্যের সমন্বিত রূপকল্প। শায়িতা এই প্রতিমাকল্পের মাথার কাছে রাখা হয়েছে একটি জলপাত্র। বিশুষ্কতার মধ্যে শায়িতা জলকন্যার সঙ্গে জলহীন এই জলপাত্রের সম্পর্ককে অন্বিত করে শিল্পী অস্তিত্বের এক সংকটকে আভাসিত করেছেন। তাঁর ‘গার্ল উইদাউট আ শ্যাডো’-তে দণ্ডায়মান মানবী, ‘বেন্ডেড স্পাইন’-এ উপুড় হয়ে থাকা নারীর রূপায়ণেও অস্তিত্বের নিবিড় শূন্যতার আভাস তুলে আনেন শিল্পী।

Advertisement

আশিস চৌধুরী প্রকৃতির সহজ রূপের ভিতর থেকে বের করে এনেছেন রহস্যময় আলো। দুটি রচনাতেই বৃত্তাকার প্রেক্ষাপট ব্যবহার করেছেন। ‘ল্যান্ডস্কেপ’ রচনাটিতে বৃহত্তর বৃত্তের মাঝখানে সংস্থাপিত করেছেন বৃত্তীয় শূন্য পরিসর। দুটি খেজুর গাছ উঠে গেছে সেখান থেকে। চারপাশে বনের আভাস। তাতে সঞ্চরণ করছে বহু বন্য প্রাণী। তাঁর ‘মৌচাক’ রচনাটিতে মৌমাছিদের উপস্থাপনা নান্দনিক বৈভব এনেছে।

পার্থ দাশগুপ্তের ‘ক্লে ট্যাবলেটস’ আটটি বিমূর্ত চতুষ্কোণের সমাহার, যার ভিতর লেখা রয়েছে ‘একটিও স্পর্শ যেন বৃথা না যায়’। স্পর্শের নান্দনিক তাৎপর্যই তাঁর এই প্রদর্শনী পরিকল্পনারও মূল সুর।

দেবাশিস দাসের ‘রিলেশনশিপ’ ফুল হাতে দণ্ডায়মান এক নগ্ন পুরুষের উপস্থাপনা। দেবজিৎ চক্রবর্তীর স্টোনওয়্যার ও লোহার সমন্বয়ে গড়া একটি রচনার শিরোনাম ‘অ্যাট নাইট হোয়েন আই কাম ব্যাক হোম’। তিনটি বলিষ্ঠ স্প্রিং-এর উপর সংস্থাপিত একটি নতোন্নত পদ্ধতির মুখাবয়ব। তাঁর অন্য একটি রচনা ‘জেনারেশন অব টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’ এক যুবকের আবক্ষ প্রতিমূর্তি। অণর্র্ব মান্না ১২টি ঝুলন্ত গিটারের রূপকল্প নিয়ে উপস্থাপিত করেছেন একটি রচনা। তাতে তিনি কাচের বোতলকে দুমড়ে অভিনব ভাবে ব্যবহার করেছেন। সঞ্জয় সামন্ত তাঁর ‘মিউজিক’ শীর্ষক রচনায় ঘূর্ণায়মান শঙ্খিল রূপের ছন্দকে ব্যবহার করেছেন কল্পনাদীপ্ত ভাবে। পল্লব দাসের ‘হনুমান’ রচনাটিতে মাথার উপর একছড়া কলার উপস্থাপনা কৌতুক সৃষ্টি করেছে। শুভ্র দাসের দুটি রচনার মধ্যে একটিতে শূকরের উপস্থাপনা। ‘ওঁ’ শিরোনামে দ্বিতীয় রচনাটি বিমূর্ত। বৃত্তীয় রূপায়ণটিতে সীমার ভিতর অসীমের দ্যোতনা আনার প্রয়াস। শিবরাম দাস একটি রচনায় গড়েছেন প্রবাহিত জলের আলেখ্য। কৃষ্ণ গোপাল গুছাইত-এর রচনাটির শিরোনাম ‘ইন অ্যান্ড আউট সোসাইটি’। অজস্র ধাতব মুদ্রার পতন বা প্রবাহের দৃশ্য। দীপঙ্কর কর্মকার সেরামিক ও কাঠে গড়েছেন বৃহদাকার মুখাবয়ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন