পুস্তকপরিচয় ১

রক্তমাংসের বড় জীবন্ত ছবি

নৈহাটির বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্রের আর্কাইভে বঙ্কিম পরিবারের মেয়েদের লেখা কিছু চিঠির যে হদিশ মিলেছে, তা বিজলি সরকারের বঙ্কিম পরিবারের মেয়েরা বইটিতেও (২০১১) ছিল। বঙ্কিম-পরিবারের মহিলাদের নিয়ে প্রথম স্বতন্ত্র কাজ সেটি।

Advertisement

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
Share:

বঙ্কিম পরিবারের মহিলাদের কথা ও চিঠি, বিজলি সরকার। কারিগর, ৩৬০.০০

বিজলি সরকারের গবেষণার ধরনটি বাঙালি পাঠকের চেনা। খুঁটিয়ে কাজ করেন, পূর্ববর্তী গবেষণার তথ্য ও বিন্যাসগত ভ্রম নিরসন যে পরবর্তী গবেষকদের গুরুদায়িত্ব, এই বিশ্বাসকে লালন করেন নিজের কাজে। আলোচ্য বইতেও বঙ্কিম পরিবারের মেয়েদের চিঠিগুলির ‘বিন্যাস ও সম্পাদনা’ অংশে কিছু চিঠির তারিখ তিনি সংশোধন করেছেন। (১১২-১৫)। জানা তথ্যের সঙ্গে সদ্য-পাওয়া তথ্যের মেলবন্ধনে, বিজলির বিন্যাসে এক দিকে মনোযোগী পরিশ্রমের ছাপ, অন্য দিকে তেমনই নতুন আর অনাগত গবেষকদের জন্য প্রেরণা।

Advertisement

নৈহাটির বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্রের আর্কাইভে বঙ্কিম পরিবারের মেয়েদের লেখা কিছু চিঠির যে হদিশ মিলেছে, তা বিজলি সরকারের বঙ্কিম পরিবারের মেয়েরা বইটিতেও (২০১১) ছিল। বঙ্কিম-পরিবারের মহিলাদের নিয়ে প্রথম স্বতন্ত্র কাজ সেটি। আলোচ্য পূর্ণাঙ্গ বইটিতে বঙ্কিম পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মের সাতাশজন মহিলার জীবন-সংলগ্ন তথ্য মেলে। সঙ্গে আছে ছাপ্পান্নটি চিঠি। একটির লেখিকা সঞ্জীবচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্রের দিদি নন্দরানী দেবী। সাতটি লিখেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী, বাকি আটচল্লিশটি সঞ্জীবচন্দ্রের একমাত্র পুত্র জ্যোতিশ্চন্দ্রের স্ত্রী মোতিরানী দেবীর লেখা। ছাপ্পান্নটিরই প্রাপক জ্যোতিশ্চন্দ্র। তাই হয়তো এই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে একমাত্র তাঁরই একটি জীবনলেখ যুক্ত করা হয়েছে। সঙ্গে আছে সযত্ননির্মিত বিস্তৃত টীকা এবং সূত্রনির্দেশ।

কেমন ছিল বঙ্কিম পরিবারের নারীদের জীবন, তার একটা আদল সাতাশটি ছোটবড় বিন্যাস পড়তে পড়তে পাঠকের মনে গেঁথে যায়। গোঁড়া হিন্দু পরিবার। ধার্মিক, কিন্তু সংস্কার-সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত নয়। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী রাজলক্ষ্মী আর তাঁর বড় মেয়ে শরৎকুমারী মেনে নিতে পারেননি শরৎকুমারীর অকালমৃত পুত্র শুভেন্দুসুন্দরের বাল্যবিধবা স্ত্রী কমলা দেবীর পুনর্বিবাহ। বিত্তের সংস্থান বা অভাব, পুরুষদের উপার্জনের নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তা কী ভাবে অন্দরের গায়ে নিজের চিহ্ন এঁকে দেয়, তার বিচিত্র মূর্তি আছে এ বইতে। ১৮৬৬ সালে যাদবচন্দ্র চার ছেলের সঙ্গে একমাত্র মেয়ে নন্দরানীকেও জমির ভাগ দিয়ে সেই জমিতে বাড়ি বানিয়ে দেন। নিঃসন্দেহে উনিশ শতকের নিরিখে এ এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভাই-বোনের সম্পর্কে স্নিগ্ধতার অভাব ছিল না।

Advertisement

বঙ্কিমের প্রথমা স্ত্রী মোহিনী কী ভাবে মিশে রইলেন চন্দ্রশেখর উপন্যাসে (৫৪), বঙ্কিমের দ্বিতীয়া পত্নীর প্রখর ব্যক্তিত্বের রেশ যে স্পষ্ট মিলে যায় বিষবৃক্ষ-র সূর্যমুখীতে (৫৭-৫৮), এ সব জরুরি তথ্য আছে বইতে। আছে ছোট মেয়ে উৎপলকুমারীর অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের অনৃতভাষণ প্রসঙ্গ। হত্যাকারী জামাতার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি তিনি। চট্টোপাধ্যায় পরিবারে পলার গলায় দড়ি দিয়ে মরবার গল্পই চালু ছিল। সঞ্জীবচন্দ্র চিঠিতে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে তেমনই লেখেন। প্রকৃত তথ্য মেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে লেখা মোতিরানীর চিঠিতে (১৩১-৩২, ১৩৫)। মোতিরানীর অন্তর্লীন বিশিষ্টতা কি কোনও না-লেখা আখ্যানের উপক্রমণিকায় নিয়ে যায়?

রাজলক্ষ্মী দেবীর চিঠিতে সংসারের দিনানুদৈনিক চলনের একটা হদিশ আছে। তিন কন্যার জননী যে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, তা স্পষ্ট। উপার্জনে, সংসার পালনে উদাসীন সঞ্জীবচন্দ্র আর জ্যোতিশ্চন্দ্র যে প্রাত্যহিক যাপনে বঙ্কিমচন্দ্রের কতখানি আনুকূল্য পেতেন, তার হদিশ রাজলক্ষ্মী, মোতিরানী, উভয়ের চিঠিতেই আছে। নন্দরানীর চিঠিটিতে জমির মালিকানার সীমা-পরিসীমা প্রসঙ্গে কিছু গোলমালের আভাস। মোতিরানীর চিঠিতে স্বামীর কাছে বার বার অনুরোধ যে পুত্রকন্যা-সহ তাঁকে যেন স্বামী নিজের কর্মস্থলে নিয়ে যান। বিরহকাতর মোতিরানী শুধুমাত্র মনের শূন্যতার কথাই লেখেন না, ব্যক্ত করেন দৈহিক সান্নিধ্যের ইচ্ছা। রাতের পর রাত একাকী শয্যার ভার যে তিনি বহন করতে পারছেন না, সে কথাও আছে। তাঁর প্রাণধারণের ইচ্ছা ফুরিয়ে আসছে, স্ত্রীর এমন কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন জ্যোতিশ্চন্দ্র। কিন্তু কাঁটালপাড়ার বাড়িতে নাবালক পুত্র-কন্যা এবং অশক্ত শাশুড়ি-সহ পুরুষ অভিভাবকহীন দিনযাপনের সময় মোতিরানীর সতীত্ব প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করতে সেই স্বামীরই বাধে না। স্ত্রীকে লিখতে হয় নিজের চারিত্রিক শুদ্ধতার প্রামাণ্য চিঠি। কখনও মোতিরানীর মনে হয়, স্বামী বুঝি দ্বিতীয় নারীতে আসক্ত, তাই তাঁকে কর্মস্থলে নিচ্ছেন না। বিরহে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলে তিনি তিরস্কৃত হন। শুনতে হয়, বঙ্কিমের কৃষ্ণকান্তের উইল পড়ে মোতিরানীদের মনের এমন হাল!

সব মিলিয়ে রক্তমাংসের বড় জীবন্ত ছবি, বায়বীয় নয় এতটুকু। অর্থের প্রয়োজন, সন্তানদের নিত্য অসুখবিসুখ, অতিরিক্ত স্নেহে তাদের অবাধ্যতা, এ সবও মোতিরানীর সমস্যা। বস্ত্রালঙ্কারের মোহ নেই তাঁর, নেই বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনও আসক্তি। যেন জ্যোতিশ্চন্দ্রের কাছে তিনি তাঁর ভুল বানানে, উপমা রূপকের আকুল ব্যবহারে মানুষের মর্যাদাটুকুই চাইছেন। অথচ সেই চাওয়াটা সমকালে এমনই বিরল যে, চাহিদার সচেতনতায় তিনি রিক্ত। কাব্যে-সংগীতে ব্যুৎপন্ন জ্যোতিশ্চন্দ্র এ-চাওয়ার মর্ম সে-ভাবে বোঝেননি। ক্রমশ মোতিরানীর চিঠির দৈর্ঘ্য কমে, কমে ভাষার আকুলতাও।

বঙ্কিমচন্দ্রের সাগর ব্রজেশ্বরকে বলেছিল, ‘যখন পরের স্ত্রী মনে করিয়াছিলে, তখন বড় আহ্লাদ করিয়া পা টিপিতেছিলে, আর যখন ঘরের স্ত্রী হইয়া পা টিপিতে বলিয়াছিলাম, তখন রাগে গর্‌গর‌্‌ করিয়া চলিয়া গেলে।’ ইন্দিরা উপন্যাসে পরস্ত্রী-জ্ঞানে নিজের স্ত্রীর প্রতি উপেন্দ্রর প্রবল অনুরাগকে কম বিদ্রুপ করেননি তিনি। যে মোতিরানী তাঁর পত্রের সূত্রে মূর্ত হন, তিনি কি সেজোকাকার তেমন পরিচিত নন? অন্যথায় পরম স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ কি হয়ে উঠতেন বঙ্কিমের কোনও আখ্যানের ভরকেন্দ্র? জ্যোতিশ্চন্দ্র আর তাঁর সংসারকে দিনানুদৈনিক বহনের তাগিদে এতটাই ভারাক্রান্ত থাকতেন বঙ্কিম যে, সংসারের ভিতরেই যে আখ্যানের এমন উপাদান আছে, তা তাঁর চোখে পড়েনি! বিজলি সরকারের এই সুবিন্যস্ত কাজটির সুবাদে পাঠক এমন জিজ্ঞাসা নাগালে পেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন