দেড়শো বছর বাঙালি যে রসে মজে আছে

জিরো বা গোল্লার আবিষ্কার মিশর, ব্যাবিলন না ভারতে— তার নিকুচি করেছে। গোল্লা রসে টইটম্বুর করার গরিমা কেউ ছিনিয়ে নিতে গেলে বাঙালির গায়ে ফোস্কা পড়বে। এই নিয়ে ওড়িশার সঙ্গে কাজিয়া। কিন্তু খোদ প্রভু জগন্নাথ জানেন, কটকের ক্ষীরমোহন আর কলকাতার রসগোল্লা এক নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪৯
Share:

জিরো বা গোল্লার আবিষ্কার মিশর, ব্যাবিলন না ভারতে— তার নিকুচি করেছে। গোল্লা রসে টইটম্বুর করার গরিমা কেউ ছিনিয়ে নিতে গেলে বাঙালির গায়ে ফোস্কা পড়বে।

Advertisement

এই নিয়ে ওড়িশার সঙ্গে কাজিয়া। কিন্তু খোদ প্রভু জগন্নাথ জানেন, কটকের ক্ষীরমোহন আর কলকাতার রসগোল্লা এক নয়। উৎকলবাসীর গর্ব নিয়ে আর যাই হোক, প্রতিবেশীর ঈর্ষা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বিশেষত, এই বঙ্গভূমে মুখেভাতের পর মুখে রসগোল্লা হতে খুব বেশি সময় লাগে না। আর যে জিভ এক বার মহাত্মা নবীনচন্দ্র দাশ মশাইয়ের (ছবিতে) শিল্পের সন্ধান পেয়েছে— আহা, দাশমশাইয়ের আত্মার শান্তি হোক— তাকে অন্য জিনিস দিয়ে খুশি করা অসম্ভব।

খাঁটি বাঙালি রসগোল্লা নিখাদ গোদুগ্ধের ছানার। তামাম হিন্দোস্তাঁয় ‘ছিন্ন’ হওয়া দুধ বা ছানা দেবসেবায় উৎসর্গ করা ঘোর না-পাক কাম। তাতে বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যায়নি। ওলন্দাজদের পট চিজ তৈরির কসরত শিখে শুরু হল হুগলিতে ছানা চর্চার নয়া ঘরানার সাধনা। যার সূক্ষ্মতম উৎকর্ষের নমুনা, রসগোল্লায়। আগে ক্ষীরের মিষ্টি খেলেও পুরীর জগন্নাথও বাঙালির ছক-ভাঙা নিবেদনের বশ। দক্ষিণেশ্বরের ‘পাগল ঠাকুর’-এর সঙ্গে মোলাকাতের আগে সিমলের নরেন দত্তেরও প্রশ্ন ছিল, উনি কি রসগোল্লা খাওয়াতে পারবেন! ইউরোপে সাহেব-মেমদের রসগোল্লার চরণে আত্মনিবেদনের ক-ত কাহিনি শুনিয়েছেন মুজতবা আলি!

Advertisement

ভ্যাকুয়াম প্যাক্‌ড টিনে রসের গোলক দেশবিদেশে পাড়ি দেওয়া ইস্তক বিশ্বসভায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ দূত তিনিই! সিক্স প্যাক অ্যাব বা সাইজ জিরো তো কালকের কথা। বাঙালির সেক্স সিম্বল বলতেও ‘কলকাতার রসগোল্লা’। তবে স্রেফ রূপসি তন্বী নয়, পোষমানা প্রাণ ভুঁড়িদার পুরুষও ‘রসগুল্লা বঙ্গালি’র প্রতিবিম্ব। কলকাতার বাইরে ভারতের অন্য কোনও শহরে জীবনের কিছুটা সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে, এমন বাঙালিমাত্রেই স্বীকার করবেন, নন-বেঙ্গলি জনসমাজে (খেয়াল রাখা ভাল, জগৎ জুড়িয়া আছে দুই জাতি, বেঙ্গলি আর নন-বেঙ্গলি) রে-টেগোর-গাঙ্গুলির তুলনায় বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে রসগোল্লার গুরুত্ব ঢের বেশি। তবে, ‘বেঙ্গলি সুইটস’ নামে তাঁরা যে পদার্থটি হাসিমুখে খান, আগমার্কা বাঙালির পাতে সেই মাল চালান করলে অসীম দুঃখ আছে।

রসগোল্লাহীন বঙ্গজীবনের কল্পনা অসম্ভব ঠেকলেও তার বয়স মোটে দেড় শতক। স্রষ্টা ‘রসগোল্লার কলম্বাস, বাগবাজারের নবীন দাশ’। রাজভোগ, রসমালাই থেকে হালের বেক্‌ড রসগোল্লা— সক্কলে রসগোল্লা বংশের সন্তান। ভোলা ময়রার নাতজামাই তথা কে সি দাশের বাবা নবীনচন্দ্রের কাজটা সোজা ছিল না।

ছানা কাটানো, বাটা, ফোটানো থেকে ছানায় আর্দ্রতা, রসে চিনির ভাগ— মাপজোক করা চাই। তবে না রসগোল্লা স্পঞ্জের মতো তুলতুলে হবে! তিলে তিলে খেতে হবে ছানাবশেষ। সবটুকু রস তারিয়ে শুষে নিয়ে জিভ-ঠোঁটের আদরে চুমুটি হবে প্রগাঢ়।

তবে রস চিপে ফেলে শুকনো ছানা চিবোনো রসগোল্লার অপমান। ক্যালরির ভয়ে যাঁরা ওই অপকর্মটি করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা যায় কি না, অনেকেই সে বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন বলে শোনা যায়।

যাঁরা আরও বেশি মৌলবাদী (রাজনীতির খপ্পরে পড়ে এই শব্দটার সর্বনাশ হয়ে গেছে। মৌলবাদী মানে যাঁরা মূল থেকে বিচ্যুত হতে চান না), তাঁরা নাকি সশ্রম কারাদণ্ডের কথাও ভেবেছেন। দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বলেছিলেন, রস ফেলে গোল্লা মানে ‘জিরো’টি খাচ্ছ কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন