পকেটের মধ্যে ‘বৈ-বই’ আমি বইবই

আমার বুড়োবেলাতে এসে দেখেছি, সেটাও হয়। তার জন্য পকেট বড় করার প্রয়োজন নেই। ছোট পকেটেই ঢুকে যাবে বই। একটা-দুটো বই নয়, চাইলে পুরো একটা লাইব্রেরি নিয়ে ঘুরতে পারেন।

Advertisement

পলাশ বরন পাল

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
Share:

ছোটবেলাতেই কোনও এক সময়ে ‘পকেটবই’ কথাটা প্রথম শুনি। তখন শুধু ইংরেজি পকেটবই-ই দেখেছি। ১৮ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১২ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার চওড়া সেই সব বই কার কোন পকেটে ঢুকত, ভেবে পেতাম না। হয়তো চেষ্টাচরিত্তির করলে পাঞ্জাবির পাশপকেটে সে বই গুঁতিয়ে ঢোকানো সম্ভব হতে পারত। কিন্তু কাউকে কখনও সে ভাবে বই নিয়ে যেতে দেখিনি। পরে বুঝেছি, আসলে সেই বই রাখার জন্য চাই কোটের পকেট। অফিসের বড়বাবুর কোট নয়। শীতের দেশে ঠান্ডা ঠেকানোর জন্য লোকে লম্বা আলখাল্লার মতো কোট পরে, সেই বিপুল ভল্লুকসদৃশ পরিধেয়তে থাকে মানানসই পকেট। পকেটবই মানে সেই পকেটে এঁটে যেতে পারে এমন বই।

Advertisement

তা আমাদের বাপু অমন জব্বর শীত নেই, তাই অমন পেল্লায় পকেটও নেই। আমাদের কি পকেটবই হতে পারে না? হলে ভাল হয়, আমরা বেশ ইশকুল-কলেজে বা অফিস-কাছারিতে যাওয়ার পথেও বই পড়তে পারি একটু ফুরসত পেলে, বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় টুক করে চোখের সামনে মেলে ধরতে পারি একটা বই, বিকেলে পার্কে বসে হাওয়া খেতে খেতে একটা বই গিলতে পারি গোগ্রাসে।

আমার বুড়োবেলাতে এসে দেখেছি, সেটাও হয়। তার জন্য পকেট বড় করার প্রয়োজন নেই। ছোট পকেটেই ঢুকে যাবে বই। একটা-দুটো বই নয়, চাইলে পুরো একটা লাইব্রেরি নিয়ে ঘুরতে পারেন, ইচ্ছে মতো দেখতে বা পড়তে পারবেন তার থেকে যে কোনও বই।

Advertisement

তবে কাগজে ছাপা বইয়ের কথা হচ্ছে না। এ হল বৈদ্যুতিন বই। ছোট করে বলতে পারেন বৈ-বই। এই নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমাদের নাতিবৃহৎ পকেটেই ঢুকে যেতে পারে বই। একটা-দুটো নয়, ডজন-ডজন, শয়ে-শয়ে বই। সবচেয়ে সুখের কথা, এর জন্য আলাদা কোনও ওজন বয়ে নিয়ে বেড়াবার দরকারও হচ্ছে না। প্রাণপ্রতিম যে ফোনটি নিয়ে আপনি ঘোরাফেরা করেন, যাতে ছবি তোলেন, কথা বলেন, তাতেই বই পড়ার সুখও উপভোগ করতে পারেন। বৈ-বই।

দু’রকমের বৈ-বই হয়। এক রকম, যাতে পুরো বইটি ওই প্রাণভোমরার মধ্যেই বসত করে, অর্থাৎ বইয়ের সমস্ত অক্ষর ওই যন্ত্রটির মধ্যেই সঞ্চিত থাকে। অন্য রকমের বইয়ের বসতি অন্য কোথাও। কিন্তু আপনার যন্ত্রটি সেই দূরদেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আপনার চোখের সামনে মেলে ধরতে পারে সেই বই।

বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় এখন নতুন বই ছাপা হয়ে বেরোলেই তার বৈদ্যুতিন সংস্করণও বের হয়। যার যেটা ইচ্ছে, সে সেটা পড়ে। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়নি এখনও, যদিও প্রায় সব ক’টি বাংলা স‌ংবাদপত্রেরই বৈদ্যুতিন সংস্করণ বার হয়। আর, নতুন না হলেও অনেক পুরনো বই এখনই পাওয়া যায় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। সেই সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে।

কী রকমের বই পাওয়া যায়? বাদ দিচ্ছি চোরাগোপ্তা বইয়ের কথা, যেগুলো ছাপা বইয়ের ছবি তুলে আন্তর্জালে টাঙিয়ে দেওয়া হয়, লেখক প্রকাশকের সম্মতি ছাড়া। তবে যে সব বইয়ের স্বত্ব চলে গিয়েছে, সেগুলো এ ভাবে টাঙানোতে বাধা নেই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গ্রন্থাগারের আস্তানা দেখলে এ রকম অনেক বই পাওয়া যায়, পদাবলি সাহিত্য থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লেখা পর্যন্ত। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বেঙ্গলি আর্কাইভ’ করা হয়েছে, তাতে পাওয়া যায় বহু পুরনো পত্রপত্রিকার ছবি-তোলা কপি। এ ছাড়া ছোটখাটো সংগ্রহ অনেক আছে, একটু খুঁজে দেখলেই পাওয়া যায় পকেটের ফোনে যদি আপনার আন্তর্জালের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে, তা হলে এগুলো সবই দেখতে পাবেন তার পর্দায়।

কিন্তু ছবি-তোলা বই ছাড়াও এমন বইও পাবেন, যেগুলো আন্তর্জালের জন্যই বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায়, এগুলো দেখতে পাবেন তো বটেই, উপরন্তু এগুলোতে কোনও কথা খোঁজাও বেশ সুবিধের।

ধরুন, আপনার মনে আবছা ভাসছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো লাইন, ‘‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,/ যাহা পাই তাহা চাই না।’’ কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোন কবিতায় পড়েছেন। ছাপানো রচনাবলি থেকে সাহায্য পাবেন না। সেখানে কবিতার নামের তালিকা বড়জোর প্রথম ছত্রের সূচি। বৈদ্যুতিন রচনাবলিতে অনুসন্ধান করুন, এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে উত্তর পেয়ে যাবেন।

এই রকম বই অনেক হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যক্তিগত উৎসাহে, যেমন এ রকম প্রথম বই (যদ্দূর আমি জানি) সোমেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যর বানানো ‘গীতবিতান’-এর সংস্করণ। বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও কিছু আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার করা হয়েছিল ‘বিচিত্রা’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা, পাঠভেদ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি সমেত। ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ (nltr.org) বার করেছেন রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি, পরে ক্রমশ যোগ হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এবং সম্প্রতি নজরুল। উইকিসোর্স (wikisource.org) নামক একটি সংগঠনে বহু স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন, তাঁরা বহু পুরনো বইয়ের বৈদ্যুতিন সংস্করণ তৈরি করেছেন। আরও আছে, খুঁজলেই পাবেন। ভেবে দেখুন, পকেট থেকে ছোট্ট খাতার মতো একটি বস্তু বার করে তাতে আপনি বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-নজরুল সকলের সব লেখা পড়তে পারবেন, যেখানে খুশি যখন খুশি। এটা আনন্দের কথা নয়? হঠাৎ বন্ধুদের মধ্যে একটা গান গাইতে হলে তার কথা সঙ্গে সঙ্গে ফোনে পেয়ে যাবেন, এটা ভরসার কথা নয়? চট করে যে কোনও লাইন খুঁজে বার করতে পারেন। সেটা কি সুবিধের কথা নয়?

অবশ্য সুখের সঙ্গে আক্ষেপও কিছু আছে। ছাপানো বই যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের একটা পেশাদারি দক্ষতা থাকে। বৈ-বই যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের অনেকেরও সেটা থাকে। ভালবেসে তাঁরা কাজে নামেন, প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ ছাড়া। কখনও দেখা যায়, বাক্যের শেষ শব্দটির পরে ফাঁক দিয়ে পূর্ণচ্ছেদ দেওয়া হয়েছে বলে সেটি পরের লাইনের গোড়ায় চলে গিয়েছে, কখনও দেখা যায় হাইফেন আর ড্যাশের তফাত এঁরা জানেন না। আর ছাপার ভুল তো থাকেই। আরও সতর্ক হওয়া কি যায় না?

গোঁড়ারা বলবেন, ‘‘থাক ও সব বিচিত্র বইয়ের কথা। হাতে খসখস শব্দ না হলে, কাগজের গন্ধ না পেলে, পড়তে ইচ্ছে করে না।’’ তাঁদের মনে রাখতে হবে, বইয়ের ভবিষ্যৎ এই বৈদ্যুতিন মাধ্যমেই। এ ভাবে বই পড়ায় অভ্যস্ত হতেই হবে। তাই তাঁদের প্রলুব্ধ এবং অন্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য আরও আরও বই আরও সতর্ক সংস্করণে বৈদ্যুতিন রূপে অবতীর্ণ হোক, এই আমাদের প্রার্থনা। পকেট থেকে ছোটখাটো চেহারার সর্বার্থসাধক (বা অন্তত বহ্বার্থসাধক) যন্ত্রটি বার করে সেই বই পড়ব, এই আমাদের ইচ্ছে। আর পকেট নিয়ে আলোচনা করছি বলে ভুলেও ভাববেন না যে শুধু পুরুষদের কথা ভেবে লেখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি চাই, মহিলাদের পরিচ্ছদেও পকেট হোক, বই না হলেও ফোন রাখার জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন