প্রবন্ধ ২

‘জাতীয় গ্রন্থ’ ঘোষণার আগে গীতার রহস্য একটু জেনে নিলে ভাল হয়

মার্কিন পণ্ডিত বলেছেন, গীতা একই সঙ্গে দুই বই। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুস্বরটি মনে রেখেই গীতা পড়তে হবে।ওয়ারেন হেস্টিংস বেঁচে থাকলে খুশি হতেন! অজস্র পৃষ্ঠা থেকে ঝাড়াইবাছাই করে তাঁর সম্পাদনায় জন্মানো বইটিই ভারতের জাতীয় গ্রন্থ! অষ্টাদশ শতক, কোম্পানির শাসন। কলকাতা ও বারাণসীর ঘিঞ্জি মহল্লায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি চার্লস উইলকিন্স অনুবাদ করছেন মহাভারত। তিনি গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে খসড়া পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনটি আলাদা করে নেন হেস্টিংস।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

গীতা প্রেরণা মহোৎসব। সতীর্থদের সঙ্গে বিদেশমন্ত্রী। দিল্লি, ৭ ডিসেম্বর

ওয়ারেন হেস্টিংস বেঁচে থাকলে খুশি হতেন! অজস্র পৃষ্ঠা থেকে ঝাড়াইবাছাই করে তাঁর সম্পাদনায় জন্মানো বইটিই ভারতের জাতীয় গ্রন্থ!

Advertisement

অষ্টাদশ শতক, কোম্পানির শাসন। কলকাতা ও বারাণসীর ঘিঞ্জি মহল্লায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি চার্লস উইলকিন্স অনুবাদ করছেন মহাভারত। তিনি গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে খসড়া পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনটি আলাদা করে নেন হেস্টিংস। তার পরই ১৮৭৪ সালের ৪ অক্টোবর কোম্পানির চেয়ারম্যান ন্যাথানিয়েল স্মিথকে তাঁর চিঠি: ‘এই পত্র যাকে নিয়ে, সে এর বিন্দুবিসর্গ জানে না।’ আরও জানান, কোম্পানির অর্থ-দাক্ষিণ্যে এই বই মুদ্রিত হওয়া উচিত। পরের বছরই কোম্পানির খরচে লন্ডনে উইলকিন্সের ‘Dialogues of Kreeshna and Arjoon in Eighteen Lectures with Notes’ বইয়ের প্রকাশ। সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনূদিত প্রথম বই। তার চেয়েও বড় কথা, পুঁথির আমলে আলাদা গীতা ছিলই না। সে ছিল মহাভারতে, শাস্ত্রীদের ভাষ্য ও টীকায়। বিদেশি শাসকের উদারতা ও খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়ার কারণে যে বইয়ের জন্ম, বিদেশমন্ত্রী তাকেই জাতীয় গ্রন্থ বলেন!

সুষমা স্বরাজের অকাট্য যুক্তি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান বারাক ওবামাকে গীতা উপহার দিয়েছেন, জাতীয় গ্রন্থ বটে! ঠাকুর, কে তোমাকে চেনাত, না চেনালে অচিন্ত্য! প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণের পর বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার গীতার শ্লোক আউড়েছিলেন। সুষমা ইচ্ছে করলে সংসদের লাইব্রেরিতে উনিশ শতকের দুই মার্কিন কবি এমারসন এবং থুরো-র বই ঘেঁটে নিতে পারেন। এমারসন বলছেন ‘গীতাই আদিগ্রন্থ’, থুরোর মতে ‘গীতার বিশাল বিশ্বদর্শনের পাশে শেক্সপিয়ারকেও কাঁচা লাগে।’ থুরো, এমার্সন দু’জনেই প্রথম উইলকিন্সের অনুবাদে গীতার সঙ্গে পরিচিত হন। বাংলায় রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে মহারাষ্ট্রে কে টি তেলঙ্গ, জার্মানিতে স্লেগেল, ম্যাক্স মুলার, সকলে গীতার অনুবাদ ও ভাষ্য লিখেছেন উইলকিন্স পড়ে।

Advertisement

ওয়ারেন হেস্টিংস বা উইলকিন্সকে শুধু সুষমা নয়, সকলের গড় করা উচিত। জনসমাজে আজ যে গীতা মানেই ভগবদ্গীতা, শ্রাদ্ধকাজে পড়তে হয়, এক কপি ব্রাহ্মণকে দান করতে হয়, সে নিয়মটি অবশ্যই ছাপা বইয়ের যুগে তৈরি। ক’টা লোক আর হাতে পুঁথি লিখতে পারত? ছাপা হওয়ার পরই গীতা সকলের হাতে হাতে পৌঁছয়, সে হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র।

মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজ দু’জনেই গীতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের বর্গে ফেলেছেন। স্মৃতি মানে পুরাণের চেয়ে ওপরে, কিন্তু শ্রুতির (বেদ) নীচে। গীতা নয়, বেদই শীর্ষে। বেঁচে থাকলে শঙ্কর, রামানুজ কেউই গীতাকে ‘জাতীয় গ্রন্থ’ বলতেন না। গীতার গুরুত্ব অন্যত্র। স্মৃতি, কিন্তু শ্রুতিতুল্য। অদ্বৈতবাদী শঙ্কর থেকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্ক বা দ্বৈতবাদী মধ্ব, সকলে এই স্মৃতি থেকেই বেছে নেন নিজস্ব দার্শনিক প্রস্থান। গীতার জন্য নয়, ব্যাসদেব বা বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়েই তাঁরা গীতাভাষ্য রচনা করছেন। এবং এক-একটি শব্দই আলাদা করে দেয় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১২ নম্বর শ্লোকে ‘জনাধিপাঃ’ শব্দ আছে। রামানুজের ব্যাখ্যা, বহু আত্মার ভেদ বোঝাতেই এই বহুবচন। শাঙ্করভাষ্যে আনন্দগিরির টীকা অন্য: এই বহুবচন দেহের নানাত্ব স্বীকার করিয়া, আত্মার নানাত্ব অভিপ্রায়ে নয়। জাতীয় ভাষ্য কোনটি হবে? শঙ্কর, না রামানুজ?

একটি কথা অবশ্য পরিষ্কার। বৈদান্তিক শঙ্কর মনে করতেন, যাগযজ্ঞকে অজ্ঞরাই প্রাধান্য দেয়। তাঁকে মানলে লালকেল্লায় গীতার পাঁচ হাজার বছরের জন্মোৎসব, পাঁচ হাজার লোককে নিয়ে যজ্ঞ, ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ঘটত না।

কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব ছাপা যুগের অবদান। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বালগঙ্গাধর টিলক, সকলের গীতাভাষ্যে তখন জাতীয়তাবাদী অনুরণন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ নম্বর শ্লোক ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ই যেন বইয়ের নির্যাস। ফলের আশা না রেখে নিষ্কাম কর্ম! শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, শঙ্কর, রামানুজ থেকে মধ্ব, নিম্বার্ক, কেউই ওই শ্লোকটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। শঙ্করের ভাষ্য: পার্থ, তোমার জ্ঞাননিষ্ঠার অধিকার নেই, কিন্তু কর্মে অধিকার আছে। কর্ম করতে করতে কর্মফলে তৃষ্ণা না হোক। যখনই কর্মফলে তৃষ্ণা হবে, তুমি কর্মফল প্রাপ্তির হেতু হবে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেই ভাষ্যের সঙ্গে আমাদের ছেদ ঘটিয়ে দেয়। কর্মফলের বদলে কর্মই তখন গুরুত্ব পেতে থাকে।

একটা ছোট্ট ঘটনা। বিপ্লবী অরবিন্দ প্রথম দিকে মেনে নিয়েছিলেন বঙ্কিমের গীতা-অনুবাদ। পরে ‘এসেজ অন গীতা’ বইয়ে তাঁর বক্তব্য, বঙ্কিম থেকে টিলক, ‘মা ফলেষু কদাচন’তে গুরুত্ব দিয়ে সবাই ভুল করেছেন। গীতার সার: সর্বধর্ম পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। বাংলায় জাতীয় গ্রন্থের কোন ভাষ্য পড়ব? বঙ্কিম না অরবিন্দ?

বছর কয়েক আগে জুয়ান মাস্কারো লিখেছিলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ মাথায় না রেখে গীতা পড়তে হবে। সম্প্রতি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড ডেভিস আবার তাঁর ‘দ্য ভগবগদ্গীতা: আ বায়োগ্রাফি’তে দেখিয়েছেন, গীতা একই সঙ্গে দুই বইয়ের দ্যোতনা। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুত্বকে মনে রেখেই পড়তে হবে। শঙ্কর-রামানুজ থেকে হাল আমলেও যে বই নিয়ে তাত্ত্বিকরা একমত হতে পারছেন না, সেটিই জাতীয় গ্রন্থ?

জাতীয় গ্রন্থের এই সওয়াল উঠল কোথায়? লালকেল্লা প্রাঙ্গণে গীতার ৫১৫১তম জন্মতিথির উৎসবে। অত দিন আগেই নাকি শ্রীকৃষ্ণ যুযুধান দুই সেনার মাঝে রথ স্থাপন করে অর্জুনকে ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি’ শুনিয়েছিলেন। পাঁচ হাজারের হিসেব কোত্থেকে এল? খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, ১৯৩৫ সালে মরাঠি শ্রীপুরোহিত স্বামীর ‘দ্য গীতা: দ্য গসপেল অব শ্রীকৃষ্ণ’ বইটি বড়োদরার মহারাজার অর্থানুকূল্যে ছাপা হয়। লেখক বইটি কবি ইয়েটসকে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে চিঠি: ‘গ্রহণ করো এই গীতা। ভারতীয় ঐতিহ্যমতে এর উন্মোচন হয়েছিল আজ থেকে ৫০৩৬ বছর আগে।’ ইতিহাস এখন নিঃসংশয়, ঋগ্বেদই মেরেকেটে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। উপনিষদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রবল অভিঘাতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অ্যাডজাস্ট করতে বাধ্য হয়। তখনই গীতার জন্ম। বোঝা গেল, সুষমারা গুজরাত, মহারাষ্ট্রের আশি বছরের পুরনো ভুলেই আমোদিত।

আর একটি প্রশ্ন। ৫১৫১ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ যদি অর্জুনকে গীতা শুনিয়ে থাকেন, সেটি ভুলে গেলেন কবে? মহাভারতের শেষ দিকে আছে অনুগীতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ, অশ্বমেধ যজ্ঞও সমাপ্ত, পাণ্ডবরা সুখে রাজত্ব করছেন, শ্রীকৃষ্ণ ফিরে যাবেন দ্বারকায়। অর্জুন তাঁকে বললেন, কুরুক্ষেত্রে তুমি কত ভাল কথা বলেছিলে, বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলে! কিন্তু কিছু মনে নেই। শ্রীকৃষ্ণ রেগে গেলেন, ‘তোমার মতো নির্বোধকে ও সব বলাই ভুল হয়েছিল।’ অর্জুন অনুনয় করতে থাকলে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘দুচ্ছাই, সে সব নিজেও ভুলে গিয়েছি। তখন যোগবশে বলেছিলাম। অন্য কথা বলি, শোনো।’ তার পরই সিদ্ধ ও তাঁর শিষ্য কাশ্যপ, পরশুরাম, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, নানাবিধ গল্প। সেটিই অনুগীতা। যুদ্ধের সময় যা বলা যায়, শান্তির সময়ে ভুলে যেতে হয়! গীতা সতিই জাতীয় গ্রন্থ। ভোটের সময় নেতারা যা-ই বলুন, পরে ভুলে যান।

ঋণ: শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অথ মা ফলেষু কদাচন’ নিবন্ধ; প্রকাশিতব্য ‘থ্রি এসেজ অন দ্য মহাভারত’ গ্রন্থের খসড়া পান্ডুলিপি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন