গণতন্ত্র। বিধানসভা নির্বাচন ২০১৬। পিটিআই
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অনেক কথা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। মানুষের রায় কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুযোগ দেয়নি। সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে নেত্রীর প্রতি মানুষের অগাধ প্রত্যয়। অনেকেই এখন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রকল্পের কথা বলছেন, কেউ কেউ বাঁকা ভাবে মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির কথাও বলে চলেছেন। কেন এমন ফলাফল হল তা নিয়ে ভোটবিশেষজ্ঞরা অনেক কথা বলবেন। কিন্তু আসলে মানুষ তাঁদের মতো করে বুঝেশুনে ভেবেচিন্তেই শাসক দলকে ফিরিয়ে এনেছেন। তবে এই নির্বাচনের পটভূমিকা সংক্রান্ত কিছু কথা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে।
নির্বাচনের আগে এই সরকারের, বিশেষ করে শাসক দলের সমালোচনা এক ঐতিহাসিক স্তরে পৌঁছেছিল। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তার ফলে, যাঁরা এ রাজ্যে বসবাস করেন না এবং নিজেদের মতামত খানিকটা খবরের কাগজ কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যম অনুসারে নির্ধারণ করেন, তাঁদের কাছে শাসক দলের চেহারাটা একেবারেই মনঃপূত ছিল না। কাজের সূত্রে দেশের ও বিদেশের অনেক জায়গায় গিয়ে দেখেছি, অনাবাসী অনেকেই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে, সরকারের ব্যর্থতা, জনগণের কাছে শাসকদের ক্রমাগত অপ্রিয় হয়ে যাওয়া— এ সব নিয়ে নানা মন্তব্য শুনেছি।
অনেকেই মানবেন যে, সংবাদমাধ্যমগুলোই যেন সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে নেমে পড়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এত সক্রিয় মিডিয়া অনেক দিন দেখেনি। গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের কাজকর্ম যে গতিতে এগিয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার সুযোগ বা সরকারের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গও সমান ভাবে আসতেই পারে। কিন্তু সেই ভারসাম্যের কাছাকাছিও না থেকে, সব সময় দোষ খোঁজার প্রবণতা বড় বেশি চোখে পড়েছে। যে গ্রামে রাস্তা হয়েছে, জল এসেছে, স্কুল হয়েছে, সে গ্রামে অন্য ধরনের সমস্যাও হয়তো হয়েছে। কিন্তু ব্যর্থতাই যেন একমাত্র বিষয়, উন্নয়নের চেষ্টা ও তার ফল নিয়ে তেমন কোনও উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা হয়নি। ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে গিয়ে বার বার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। মেয়েদের ওপর অত্যাচারের খবর নিশ্চয়ই গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কিন্তু সেই খবর এমন ফলাও করে বার করা হয়েছে, যেন পশ্চিমবঙ্গে একটা নৈরাজ্য চলছে! মিডিয়ার এ বিষয়ে বিধান দেওয়ার আগে একটু ভাবা উচিত ছিল না কি? আবার অন্য দিকে কন্যাশ্রী প্রকল্প নিয়ে বিশদ ভাবে বিশ্লেষণী খবর বা ন্যায্যমূল্যের দোকানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চোখে পড়েনি। এটা সংবাদমাধ্যমের একটা বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার ফল তার নিজের পক্ষেও ভাল নয়। সংবাদমাধ্যমের জনমতকে প্রভাবিত করার একটা ক্ষমতা থাকে। এই ব্যর্থতা তার সেই ক্ষমতায় আঘাত হানতে পারে। এই নির্বাচনের ফলাফল তার একটা বড় প্রমাণ।
মিডিয়ার চোখে যেন ভোট মানেই ছিল গুন্ডাবাজি, ভোট দিতে না দেওয়া, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট। বাস্তবে ঘটনাটা কেবল তা-ই কি? যদি শাসক দলের কাজকর্মের দিকে একটু তাকানো যায়, তা হলে কিন্তু পাঁচ বছরের খতিয়ান কেবল অন্যায় আর ব্যর্থতার কথা বলবে না। দু’টাকা কিলো চাল আর সাইকেল যদি ভুলেও যাই, সাধারণ চোখে পশ্চিমবঙ্গের চেহারা যে খানিকটা পালটেছে, সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তো ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন নির্বাচনী প্রচারে শাসক দলকে তুলোধোনা করছেন তখন কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলো সফল ভাবে কার্যকর করার জন্য এই রাজ্যটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একের পর এক স্বীকৃতি ও পুরস্কার পাচ্ছে। পঞ্চায়েতের একাধিক উন্নয়নমুখী কাজ বিশ্ব প্রতিষ্ঠানে প্রশংসিত হচ্ছে। অতি কটুভাষী প্রতিপক্ষীয় বিদেশবাসী বলে যাচ্ছেন, কলকাতা এখন বেশি পরিষ্কার আর দেখতে-শুনতে আগের চেয়ে খানিকটা সুন্দর। এ সব নিয়ে বিশদ ভাবে লেখা বা বলার ব্যাপারে কেমন যেন অনীহা লক্ষ করা গিয়েছিল। মানুষের কি কাজ দেখে ভোট দেওয়ার কোনও অধিকার নেই? ভোটের ব্যবস্থা সেই অধিকার যতটুকু করে দেয়, তাকে অন্যায্য আখ্যা দেওয়া তো অনুচিত। ভারসাম্য রক্ষা যে কোনও দায়িত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের মূল শর্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। মন্দের পাশাপাশি ভালর অস্তিত্ব অস্বীকার করলে কিছু দিন পরে সমালোচনার গুরুত্ব খাটো হতে বাধ্য।
কিছু বিষয় নিয়ে জানি বলেই আরও বলছি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারটি আজ যতটা স্বচ্ছ, তা এই সরকার আসার আগে দেখা যায়নি। অথচ সব সময় শিক্ষাপ্রাঙ্গণে স্বাধিকার দমনের কথাই শুনে গেল মানুষ। অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে ওষুধ অনেক কম দামে পাওয়া যায়, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলোর কল্যাণে। এই বৈপ্লবিক পদক্ষেপটি না হলে আমরা জানতেই পারতাম না যে, সর্বাধিক খুচরো দামের (এমআরপি) তুলনায় এত কম দামে অনেক জায়গায় ওষুধ পাওয়া যেতে পারে। কিছু দিনের মধ্যে সারা দেশের তুলনায় এ রাজ্যে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স বেশ খানিকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জোরদার, কারণ কন্যাশ্রী। একশো দিনের কাজে পশ্চিমবঙ্গ সব রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে। বহু প্রত্যন্ত জায়গায় ভাল রাস্তার কথা কাউকে বলে দিতে হবে না।
একটি দলের কী কারণে ভোট পাওয়া উচিত বা উচিত নয়— সে কথাটা বলার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের ওপর বর্তায়। ‘না’-এর ফর্দটা বিরোধী পক্ষ জোর করে ভরাবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু সংবাদমাধ্যম বিরোধী পক্ষ হয়ে পড়লে গণতন্ত্রের হানি। ভারসাম্য রেখে ভাল-মন্দের তুল্যমূল্য বিচার করে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ রাজ্যের এক জন মানুষ হিসেবে আমার অভিযোগ, অনেক সংবাদমাধ্যমই সে দায়িত্ব পালন করেনি। শাসক দলেরও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন হয়তো আছে। তাদের খারাপ দিকটার সমালোচনা তীক্ষ্ণ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু অনেক গঠনমূলক কাজকর্ম অবহেলিত হয়েছে। এবং সংবাদমাধ্যমগুলো বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতার দিকে এতটা ঝুঁকেছিল যে নির্বাচনের ফল আঁচ করতেই পারেনি। মানুষের মনের থেকে সংবাদমাধ্যমের এতটা দূরত্ব গণতন্ত্রের পক্ষে খুব আশার কথা নয়।
আবারও বলি, সরকার বা শাসকদের সমালোচনা নিশ্চয়ই সংবাদমাধ্যমের একটা বড় কাজ। সরকারের কাজে খামতি থাকবে, সমালোচনা হবে, আন্দোলন হবে, সরকারকে সচেতন করতেই হবে। কিন্তু আমার বাড়ির সামনে রাস্তা হল কি না, সেটা জানতে কাগজ পড়তে হয় না, টিভি দেখতে হয় না। তাই, সংবাদমাধ্যম সরকারের গঠনমূলক কাজকর্মগুলোকে একেবারেই চিহ্নিত না করলে মানুষ দেখে, তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ‘সংবাদ’ মিলছে না। মানুষ যদি শুধু বিনোদনের জন্য খবর পড়ে বা দেখে, তাতে ঠিকঠাক জনমত গঠিত হয় না। সমালোচনামূলক আলোচনা যদি বিনোদনমূলক ঝগড়ার আখড়া হয়, পত্রপত্রিকার প্রচারসংখ্যা বা টিভি চ্যানেলের টিআরপি ভাল থাকতে পারে, কিন্তু জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমে যায়। আমরা সিনেমা দেখতে অনেক পয়সা খরচ করি কিন্তু সিনেমার ঘটনা সত্য বলে বিশ্বাস করি না। সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমলে সংবাদমাধ্যমের মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও কমতে থাকবে। এটা সংবাদমাধ্যমের পক্ষে হিতকর নয়। তাঁদেরও বোধ করি এ বার আত্মসমীক্ষণের প্রয়োজন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মতামত ব্যক্তিগত