প্রবন্ধ ২

যে স্টার সে মনস্টার

যদি বলি, আমার কোটি কোটি টাকা, তাই ‘হামার’ গাড়ি দাবড়াচ্ছি, সবার মুখ একদম কষা পেয়ারা। যদি বুলেটপ্রুফ রিকশা চড়ে যাতায়াত করি, পৃথিবী খুশি।আরে, বাংলাদেশের সঙ্গে দুটো ম্যাচ হারতে না হারতে আমি ডাইনোসর হয়ে গেলাম? সারা জীবন শসার মতো ঠান্ডা মাথায় তাবৎ ক্রাইসিস সামলে, এক দিন একটা পেসারকে ধাঁইসে ধাক্কা মেরেছি বলে আমার মেজাজ হয়ে গেল দু’নম্বরি স্টোভের মতো এই বার্স্ট তো সেই বার্স্ট?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আরে, বাংলাদেশের সঙ্গে দুটো ম্যাচ হারতে না হারতে আমি ডাইনোসর হয়ে গেলাম? সারা জীবন শসার মতো ঠান্ডা মাথায় তাবৎ ক্রাইসিস সামলে, এক দিন একটা পেসারকে ধাঁইসে ধাক্কা মেরেছি বলে আমার মেজাজ হয়ে গেল দু’নম্বরি স্টোভের মতো এই বার্স্ট তো সেই বার্স্ট? সত্যি, এই জনগণ কী জিনিস! মাথায় তোলা আর পায়ে ফেলা এদের কাছে একই ইয়ের এপিঠ ওপিঠ। বউয়ের সঙ্গে কেমন রাত্রিব্যবহার করে কে জানে। এই চুমু দিল, পর মুহূর্তেই গুম করে একখান কিল! মাথা আমার সত্যিই বরফ-চাপানো টাইপ, ইমেজ হয়ে যাওয়ার পর তো আরও ইচ্ছে করেই ঠোঁটফোঁট চেপ্পেটিপ্পে একদম সরলরেখায় টাইট রাখতে হয়। হড়কে গিয়ে অভিমানটা সে দিন বেরিয়ে পড়েছে। খারাপই হয়েছে। রাজপথে ছ্যারছ্যার করে ইমোশন ছড়ানো ভদ্রলোকের কাজ নয়। কিন্তু সহ্যের লিমিট আছে তো। ক্যাপ্টেন্সি করে অ্যাদ্দিন ধরে একের পর এক ম্যাচ জেতাচ্ছি, পতাকা নামতেই দিচ্ছি না, তাইলে আমার ক্ষতি হলে ভারতীয়দের এত উল্লাস কীসের? আমায় দোষ দিতে পারলে আর কেউ কিছু চায় না। কেন? আমার ঔদ্ধত্য আছে বলে? কাউকে পাত্তা দিই না বলে? আমার কি ভক্ত হনুমানের মতো, ভণ্ড রাজনীতিকগুলোর মতো জনতা জনার্দনের কাছে হাতজোড় করে মিনমিন করা উচিত ছিল?

Advertisement

ভারতীয়গুলো আচাভুয়া পাবলিক। এরা যাকে পুজো করবে, তার কাছে আবার মেনিমুখো গিড়গিড়ানিও আশা করবে। মানে, যে কীর্তিমান, তাকে বারে বারে বলতে হবে, ‘হেঁ হেঁ, কী আর এমন করেছি। স্রেফ কপালজোরে এক একটা মিটিঙে অডিশনে পার্টিতে পৌঁছে গেছিলাম মাত্র!’ তখন এরা ‘অহো, কী বিনয়! এই না হলে সুপার-মানুষ!’ জয়ধ্বনি করবে। আমি যদি বলি, হ্যাঁ রে ড্যাকরা, আমার কোটি কোটি টাকা, তাই ‘হামার’ গাড়ি দাবড়াচ্ছি, বেশ করেছি, সবার মুখ একদম কষা পেয়ারা। যদি বুলেটপ্রুফ রিকশা চড়ে যাতায়াত করি, পৃথিবী খুশি। মানে, এদের দৈত্য-ফ্যান্টাসির পাশাপাশি, বনসাই-শখ আছে। একই লোককে, এক বার আতস কাচ দিয়ে ফাঁপিয়ে এমন টঙে চড়াবে, যেন তার হাঁচিও আসলে রকেট-উৎক্ষেপণ মন্তর, আবার বিকেল বাজলে তাকেই দূরবিনের উলটো কাচ দিয়ে এমন তেরছা নজরে বিঁধবে, যেন নোবেল প্রাইজটাও ফড়েপুকুর থেকে গড়িয়ে এনেছে। কিন্তু আমি কোটিকে গুটিক, অহংকার আমার লকেট, নিজেকে ছেঁটে এই প্যারাডক্সবিলাসী নেকুদের সামনে গুটিয়ে থাকতে পারব না।

আসল কথা বলি? কেন লোকের আমার ওপর রাগ? কারণ আমি সফল। এমন অবিশ্বাস্য টাইপের সফল, উন্মাদের মতন ট্রফিময়, লোকের আমাকে গড়াগড়ি যেতে দেখলে অদ্ভুত সেডিস্ট আমোদ পায়! বড়লোক বা বিখ্যাত লোক যখন পাঁকে পড়ে, গরিবগুর্বো দিয়ে তৈরি এই সমাজ একটা ‘বেএএশ হয়েছে!’-র হিস্টিরিয়ার চান করে। নামী লোকের পরাজয়ের কোয়া ছাড়াতে ছাড়াতে বৃহত্‌ জটলার সম্মিলিত অর্গ্যাজ্ম হয়ে যায়। কারণ, তাদের অহরহই খোঁচা লাগে, এই মরা বেড়াল ছড়িয়ে থাকা জীবনে হঠাৎ এই লোকগুলো কোন গলতায় রূপকথার লটারিটি কুড়িয়ে পেল? আমাদের দিন যাচ্ছে শুধু বিরক্তির ব্রণ খুঁটে, আর একই গ্রহে বাস করে সুঁকসুঁক দূষিত অক্সিজেন টেনে এই বাছাধনেরা সেঁধিয়ে গেল বিজ্ঞাপনের ব্রাইট গোলাপি শটে? শিয়োর ঘাপলা হ্যাজ। শয়তানের কাছে মিনিমাম দেড় কিলো আত্মা বিক্রয়ের গল্প আছেই ঝোপেঝাড়ে।

Advertisement

দোষও দেওয়া যায় না। চার পাশে তাকিয়ে এই পৃথিবীর ব্যাপার প্লাস স্যাপার ‘বাঃ, বেশ তো’ বলে মেনে নেওয়া হেভি শক্ত। হয় ব্রহ্মে বিশ্বাস লাগে, কিংবা টোটাল নোড়েভোলা হতে হয়। এমন সব খরখরে অবিচার অসাম্য বঞ্চনা রোজ রোজ মানুষকে গিলছে ও পরবর্তী কুমিরের জিভের ডগায় উগরে দিচ্ছে— সে সবের ভিকটিম হয়েও, প্রসন্ন বদনে বিটনুনময় ডালবড়া খেতে খেতে হেঁটে যাওয়া প্রায় এক ওভারে চুরাশি। কিন্তু সারা ক্ষণ খ্যানখেনিয়ে খেরে থাকলে তো জীবনে একটা প্রেম-সেশন অবধি ঠিকঠাক চালানো যাবে না! (ও কী গো, অত জোরে দাঁত কশকশ করছ কেন? কিছু না, অম্বানিদের সাতাশ তলা বাড়িটার কথা ভাবছিলুম।) তাই, হেভি ভেবেচিন্তে, সাধারণ মানুষ, সারভাইভাল ইনস্টিংক্টেই, ঠিক করে নিয়েছে, যাঁরা গণ্যমান্য, তাঁরা অতি জঘন্য। একটা কেরানি যে টাকা একশো বছরেও রোজগার করতে পারবে না, সেই টাকা তুড়ি মেরে এক মাসে কামায় যে লোকটা, তাকে যদি কেরানিটা টুপি খুলে শুধু সম্মানই জানাতে থাকে, নিজের দুর্ভাগ্য বা মুরোদহীনতার মুখোমুখি হবে কী করে? তার চেয়ে যদি নিজেকে জপিয়ে নেয়, ‘ভগবান ওকে দিয়েছেন মিনারেল ওয়াটারে জলশৌচ করার বিলাসিতা, কিন্তু হৃদয়ে লেপেছেন আলকাতরা’— স্লাইট জ্বলুনি কমবে। তাই লোকে আমায় স্টারের স্টার করেছে, একই সঙ্গে ভাবছে মনস্টারের মনস্টার। আমার ছক্কা দেখে লাফিয়ে গোড়ালির লিগামেন্ট ছিঁড়ছে, আবার দাপাচ্ছে, এই তোদের ক্যাপ্টেন ‘কুল’, সংকটকালে আনস্পোর্টিং? ভেবেছিলি প্রলয় অবধি টানা ও-ই ক্যাপ্টেন? এ বার মজা বুঝবে, যখন নাকে ঝামা ঘষে ওকে করে দেবে ঋদ্ধিমানের তলার উইকেটকিপার!

সুখের সংজ্ঞা হল, প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে যে আবেগ বুকের মধ্যে গুড়গুড়োয়। ভারতীয় মানুষের সুখ ঘটে, যখন আচমকা হু-ই উঁচু থেকে কোনও ঈগল লাট খেতে খেতে ঝপাং এসে ছাদের কলঘরে পড়ে। এ বার একটু দূর থেকে ব্যাটার দুর্দশা চাখো আর কমেন্ট্রি দাও। যার নাগাল এ জম্মে পাওয়ার কথা নয়, দৈব চক্করে সে-ও আমাদের মতোই দাঁত ছরকুটে পড়েছে, সেই আহ্লাদে জনতার তেলচিটে মশারি রনরন করে। আমার ইমেজে হাসা বারণ না হলে, তোদের নিন্দে শুনে আমি যাত্রাপালার অজিতেশের মতো কেঁপে কেঁপে হাসতাম!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন