প্রক্সি-মানুষ

জাপানে এক গবেষক আবিষ্কার করিলেন টেলি-মুখোশ, যাহা অন্যকে পরাইয়া, নিজের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যাইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০২
Share:

প্রতীকী ছবি।

আধুনিক গীতিকার লিখিয়াছেন, ‘বোরিং এ জীবন/ থাকলে দুটি ক্লোন/ একটি যেত মাছ ধরিতে/ অন্য শবাসন।’ সেই গান শুনিয়াই কি না কে জানে, জাপানে এক গবেষক আবিষ্কার করিলেন টেলি-মুখোশ, যাহা অন্যকে পরাইয়া, নিজের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যাইবে। অর্থাৎ, একটি লোক ডাকিয়া, তাহাকে পয়সা দিয়া, তাহার মুখে স্ট্র্যাপের সাহায্যে টেলি-পরদা বাঁধিয়া দেওয়া হইল। এই বার, যিনি পয়সা দিলেন, তিনি নিজের মুখ সেই পরদায় ভাসিত করিলেন। ফলে মুখোশ পরা লোকটি হইয়া গেল এই লোকটির ক্লোন। আসল লোকটি ঘরে বসিয়া আরামে চানাচুর খাইবেন, আর তাঁহার কিছু পোশাক পরিয়া, এই বেতনভোগী লোকটি তাঁহার পরিবর্তে তাঁহার কাজগুলি করিয়া বেড়াইবে। পুরা সময়টি অবশ্য আসল লোকটি ল্যাপটপের সাহায্যে দেখিতে পাইবেন বিকল্পটি কোথায় যাইতেছে কাহার সহিত দেখা করিতেছে, এবং কথাও বলিতে পারিবেন সেই ব্যক্তিগুলির সহিত, নিজ কণ্ঠস্বরেই। আর বিকল্প লোকটিকে উপদেশ দিয়া যাইবেন, কেমন ব্যবহার করিতে হইবে। এই টেলি-অস্তিত্ব নূতন নহে, ইহার পূর্বেও রোবটের মুখে টেলি-পরদা লাগাইয়া তাহাতে নিজ মুখ ভাসিত করিয়া কিছু মানুষকে অফিসে মিটিং করিতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু নিজ গড়নের, নিজ পোশাক-পরিহিত, নিজ ব্যবহার নকল করিতে সমর্থ মানুষকে দিয়া ইহা করানো হইলে, তাহা অন্য লোকের নিকট (এমনকী স্কাইপ বা টেলি-কনফারেন্সিং’এর তুলনায়) অধিক বিশ্বাস‌যোগ্য হইয়া উঠিবে বলিয়া গবেষকের ধারণা। প্রশ্ন অনেক। সেই যদি মানুষটিকে প্রতিনিয়ত নজরই রাখিতে হইল, বিকল্পটি কাহার সহিত কেমন ব্যবহার করিয়া বসিল, তাহা হইলে আর অবসর যাপন হইল কোথায়। দ্বিতীয়ত, রাম বা শ্যামের সহিত কথা বলিতে আসিয়া কেহ যখন এই ‘ক্যমিলিয়ন মাস্ক’ বা ‘বহুরূপী মুখোশ’ পরিহিত বিকল্পের সহিত কথা বলিবেন, তিনি কি সম্মুখের মানুষটিকে সমান গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করিবেন? সেই সকল কথা বলিতে পারিবেন, যা প্রকৃত লোকটিকে বলিতেন? কারণ এই ‘প্রক্সি-মানুষ’টিরও তো নিজ চেতনা রহিয়াছে, সে তো সেই ব্যবসায়-বিবৃতি বা প্রণয়-বার্তাগুলি শুনিয়া লইল, যাহা অন্য কেহ শুনিবে বুঝিবে তাহা তেমন কাঙ্ক্ষিত ছিল না?

Advertisement

অবশ্য আবিষ্কারটির সুবিধাও প্রচুর। বহু মানুষের একই সময়ে দুইটি অতি জরুরি কাজ পড়িয়া যায়। অফিসেও মিটিং রহিয়াছে, সহসা পুত্রের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডাকিয়া পাঠাইলেন। তখন নিজে স্কুলে যাইয়া, পরিবর্তটিকে অফিসে পাঠাইয়া, মোবাইলের সাহায্যে সামাল দিয়া পরিস্থিতি আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। প্রতিবন্ধী, অশক্ত বা অসুস্থ মানুষের পক্ষে এই পদ্ধতি অত্যন্ত বড় আশীর্বাদ হইয়া দাঁড়াইতে পারে। তাঁহারা শয্যাশায়ী বা হুইলচেয়ারবন্দি হইয়াও অতি সহজে বিদেশ যাইয়া কারখানা পরিদর্শন করিবেন বা রাষ্ট্রনায়কের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। পরকীয়া করিবার ক্ষেত্রেও ইহা নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিতে পারে। অবশ্য, অতি গ্যাজেটপ্রিয় মানুষও টেলি-ওষ্ঠে চুম্বন করিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করিবে কি না, বলা কঠিন।

তবে হ্যাকিং বা অন্য উচ্চ-প্রযুক্তিগত জুয়াচুরি ইহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলে, জীবন ক্রমে উত্তরাধুনিক উপন্যাসের ন্যায় জটিল ও আকর্ষক হইয়া উঠিবে। এক জন নিজেই সিদ্ধান্ত লইয়া রামের টেলি-মুখোশ পরিয়া কাহাকেও ঘুষ দিল, বা গাঁট্টা মারিল। রাম এ-বিষয়ে জানেনও না। কিন্তু সিসিটিভি-তে ধরা পড়িল, তাঁহারই মুখ পরদায় ভাসিত, এবং কণ্ঠস্বরও তাঁহারই (দক্ষ হ্যাকারের কাণ্ড)। এই বার, রামেরই উপরেই নিজ দোষহীনতা প্রমাণের দায় বর্তাইবে। এই অস্তিত্ব-চৌর্য যদি বাড়িয়া যায়, দশ মুখোশে ভগবানকে ভূত করিবার প্রয়াস উত্তরোত্তর বাড়িতে পারে, শত্রুরা সকলেই বলিতে পারে, ওই দিন ওই লোকটিই আমাকে বলিয়াছিল উহার মুখোশ পরিয়া অমুক কাজ করিতে, উহার সাহায্য ব্যতীত আমি পাসওয়ার্ড পাইব কোথায়! আবার, অতি ধূর্ত কেহ, নিজের মুখোশ পরিয়া এমন করিয়া চলিতেফিরিতে পারে, যেন সে পরিবর্ত কেহ, এবং স্ত্রীর নিকটে গিয়া যাচাই করিতে পারে তাহার আনুগত্য, বা ব্যাংক ডাকাতি করিয়া বলিতে পারে, কেহ মুখোশ চুরি করিয়া আমাকে ফাঁসাইয়া দিয়াছে। হেড অফিসের বড়বাবু তখন চটকা ভাঙিয়া চিৎকার করিবেন, আমার মুখোশ গিয়াছে চুরি! এবং আধুনিকতর কবি লিখিবেন, মুখোশের আমি মুখোশের তুমি, মুখোশ কি কাহারও কেনা!

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

বঙ্গবাসীর মহা সংকট। এক কালে ব্যায়ামকে সে দুয়ো দিয়েছে, কিন্তু এ বার তো পেশিময় না হয়ে উঠলে চলবে না। শিক্ষক হলে, অভিভাবকদের কাছে মার খেতে হতে পারে, ছাত্রনেতার কাছেও। যাত্রী হলে অটোচালকদের কাছে। পুলিশ হলে জনতার কাছে। সংগত-অসংগত যে কোনও কারণেই লোকে রেগে উঠলে গোড়াতেই ব্যাপারটা ধোলাইয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই মারকুটে সমাজে বাঁচতে গেলে হয় লৌহবর্ম পরুন (গরমে খুব কষ্ট), অথবা বাঙা-লি ছেড়ে ব্রুস লি হোন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন