অন্তত পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় সেনা অংশ লইয়াছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। এই বিপুল সংখ্যার কারণেই সামরিক নথিতে এই বাহিনীকে বলা হইত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি। কিন্তু পরবর্তী কালের বিশ্বযুদ্ধ-স্মৃতি হইতে এই অংশটুকু কী করিয়া যেন উধাও হইয়াছে। সম্প্রতি ডানকার্ক নামক চলচ্চিত্রটি সমালোচক মহলে প্রশ্নটি আবার নূতন করিয়া জাগাইল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ক্রিস্টোফার নোলান-এর সিনেমাটি সাধারণ ভাবে দর্শকের উচ্চ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। তাই, জার্মান বাহিনীর বিপরীতে ব্রিটিশ সেনাদের সাহসিকতা ও দুর্দম মনোবল দেখাইবার পাশাপাশি অব্রিটিশ সেনাদের মুখচ্ছবি কেন থাকিল না, এই সমালোচনা প্রশংসার সহিত পাল্লা দিয়া জমিতেছে। একটিমাত্র চলচ্চিত্র হইতে হয়তো বৃহত্তর সমাজমানস অনুমান করিয়া লওয়া বাড়াবাড়ি। কিন্তু ডানকার্ক-এর মতো একটি গবেষণাভিত্তিক যত্ননির্মিত চলচ্চিত্রে এই সচেতনতার অনুপস্থিতি কি উল্লেখযোগ্য নয়? ডানকার্ক-কে কি শেষ পর্যন্ত একটি বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র বলিয়া ধরা উচিত? না কি ইহাকে সমাজমানসের প্রকাশ-ঘরানার প্রতিনিধিস্বরূপ ভাবা উচিত? এই সব অস্বস্তি-উৎপাদক প্রশ্নের সামনে দাঁড়াইয়া বলাই যায় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঔপনিবেশিক সৈন্যদের অংশগ্রহণের বিষয়টি হেয় করিয়া দেখা কিন্তু প্রাক্তন উপনিবেশকারী দেশটির একটি স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উপনিবেশ-যুগ শেষ হইবার পর এতগুলি দশক কাটিয়া যাওয়ার পরও উপনিবেশের প্রতি এই অবজ্ঞা ও অবহেলা অত্যন্ত আপত্তিকর। ইহার মধ্যে একটি ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ কিংবা ঔপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার যদি কেহ আঁচ করেন, তাঁহাকে ভুল বলা যাইবে না।
আপত্তিটি গুরুতর। আয়তনে ক্ষুদ্র দেশটি বিশ শতকের দুটি বিশ্বযুদ্ধেই যে প্রবল প্রতাপ দেখাইতে সমর্থ হয়, তাহার কৃতিত্বের একটি বড় অংশই কিন্তু উপনিবেশের। শুধু ভারত নহে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, পৃথিবীজোড়া ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি যুদ্ধের সময় ব্রিটেনকে তাহার মানবসম্পদ এবং অন্যান্য জাগতিক সম্পদ-সহ সাহায্য না করিলে তাহার এই গরিমা জুটিত কি? পঁচিশ লক্ষ সেনা ভারত একাই পাঠাইয়াছে, আর অন্যান্য উপনিবেশ মিলাইয়া পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রভুদেশের আদেশে হাতে অস্ত্র তুলিয়া লইয়াছে, দূরদূরান্তরে প্রাণ তুচ্ছ করিয়া ছুটিয়া বেড়াইয়াছে, নিজেদের প্রাণ বলি দিয়া ব্রিটেনকে জিতাইয়াছে। ইতিহাস গবেষণায় এই ঘটনা যথেষ্ট বড় জায়গা পাইয়াছে, ক্রিস্টোফার বেইলি, ডেভিড কিলিংরে, শ্রীনাথ রাঘবনের মতো ইতিহাসবিদরা দুর্দান্ত পরিশ্রমে এই ঔপনিবেশিক বাহিনীর কথা লিখিয়াছেন। কিন্তু, সারস্বত ইতিহাস চর্চার বাহিরে যে গণপরিসরের ইতিহাস চেতনা, সেখানে উপনিবেশ অনুপস্থিত। ব্রিটেন যেন ব্রিটেনের জোরেই ব্রিটেন, এই ভুল চেতনা সে দেশের জনমানসে ক্রমেই প্রোথিত হইতেছে।
ব্রেক্সিট-আন্দোলিত ব্রিটেনে এই ভুল চেতনাটির দিকে আঙুল তোলা আজ আরওই জরুরি। ব্রিটেনের বর্তমান গুরুত্বের পিছনে বহির্বিশ্বের কী ভূমিকা, সেই সত্যকে এত দ্রুত উবিয়া যাইতে দেওয়া যাইবে না। বাকি ইউরোপ তো বটেই, এশিয়া ও আফ্রিকা না থাকিলেও ব্রিটেন যে এই জায়গায় আসিতে পারিত না, তাহার আজিকার ভুবনবোধে এই উপলব্ধির কোনও স্থান থাকিবে না? ইংল্যান্ডের যুদ্ধ-জাদুঘরগুলির রূপসজ্জায় উপনিবেশের বিচিত্র ইতিহাসকে কি অনেক বেশি স্থান দেওয়া উচিত নয়? ভারতকে কোহিনুর রত্ন ফেরত দেওয়া উচিত কি না, তাহা একটি জটিল নৈতিক প্রশ্ন হইতে পারে। কিন্তু ভারতকে তাহার যোগ্য ঐতিহাসিক গুরুত্বটি দেওয়া হউক, এই দাবির মধ্যে কোনও অনাবশ্যক জটিলতা নাই। কেবল ঐতিহাসিক ন্যায্যতা আছে।