প্রবন্ধ ২

ছোট্ট জিজ্ঞাসা

সত্যি বলব? ঠিক বুঝতে পারছি না ভাল হল না মন্দ হল। এক মহাপুরুষ নাকি বলেছিলেন, ‘যে কনফিউজ্ড নয়, সে কিছুই বোঝেনি।’ শুনে প্রথমটা মনে হয়েছিল হালকা রসিকতা, এখন মনে হয় আপ্তবাক্য। যারা ফটাস ফটাস করে নিশ্চিত সমস্ত মত দিয়ে দেয়, ফেসবুকে বা টিভিতে, কিংবা সভার উঁচু মাচায়, তাদের দেখে বেশ স্তম্ভিত লাগে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

সত্যি বলব? ঠিক বুঝতে পারছি না ভাল হল না মন্দ হল। এক মহাপুরুষ নাকি বলেছিলেন, ‘যে কনফিউজ্ড নয়, সে কিছুই বোঝেনি।’ শুনে প্রথমটা মনে হয়েছিল হালকা রসিকতা, এখন মনে হয় আপ্তবাক্য। যারা ফটাস ফটাস করে নিশ্চিত সমস্ত মত দিয়ে দেয়, ফেসবুকে বা টিভিতে, কিংবা সভার উঁচু মাচায়, তাদের দেখে বেশ স্তম্ভিত লাগে। কী আত্মবিশ্বাস! কী তকতকে মাথা, ঝকঝকে সিদ্ধান্ত! তোতলাচ্ছে অবধি না! আর আমার নিজের শরীর ও পেশা মেশানো এই যে ব্যাপারটা, এই যে আমি গর্ভ ভাড়া দিই ও রোজগার করি, তা নিয়ে যখন এত বখেড়া শুরু হয়ে গেল, তখন আমিই বেশ ঝাপসা গর্তে পড়ে গেছি।

Advertisement

প্রথমে অবশ্যই রাগ হয়েছিল। আমার পেশাটা কেড়ে নিচ্ছে সরকার! আমি যদি রাজি থাকি গর্ভ ভাড়া দিতে, এবং অন্য লোকে যদি আমার গর্ভ ভাড়া নিতে রাজি থাকে, আর দুই পক্ষের যদি দরে পোষায়, তা হলে তুমি কে বাওয়া মধ্যিখান থেকে নাক গলাবার? ভারতীয় মূল্যবোধের তো গায়ে লাগবেই, সে ভারী ঠুনকো ও স্বাধীনতাবিরোধী। আর, অশান্তি পাকাবার জন্যে মুখিয়েই আছে, বাসের ঝগড়াটে প্যাসেঞ্জারের মতো। এ দেশে প্রথার বাইরে কিছু হলেই একটা ঝন্‌ন্‌ন্ শব্দ হয় এবং বুড়োটে মস্তিষ্কের লোকেরা হাঁইহাঁই তেড়ে আসে। প্রায় চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, এরা ভারতকে টেনে বেঁধে রাখার চেষ্টা করছে না-ভাবার খুঁটোয়, চাইছে চণ্ডীমণ্ডপে বসে নতুন-কে হাড়িকাঠে চড়াতে।

এদের হয়তো মনে হয়েছে, ভগবান যাকে সন্তান দিচ্ছে না, সে কেন কৃত্রিম উপায়ে সন্তান পাবে? তাও যদি ওষুধ-বিষুধের সাহায্যে নিজেকে গর্ভবতী করে তুলত কোনও নারী, তবু মেনে নেওয়া যায় (যদিও তা-ও খোদার ওপর খোদকারি এবং বিষফোড়ার ওপর গোদকারী), কিন্তু এ কাজে অন্যের গর্ভ ভাড়া নেওয়া পেল্লায় অনুচিত, কারণ মাতৃত্ব বাণিজ্য-বিষয় হতে পারে না। ‘দাম্পত্য-ব্যক্তিগত’ ব্যাপার এমনিতেই অন্য একটি মানুষকে জড়িয়েমড়িয়ে তার পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, আর মাতৃত্বের মধ্যে টাকা আনলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জিনিসটাকেই লাভ-ক্ষতি ছুঁইয়ে হাকুশ নোংরা করা হল!

Advertisement

শুনে একটু হাসি পায়। মনে হয়, মাতৃত্বকে একটু বেশিই লাই দেওয়া হয় পৃথিবীতে। মা ও সন্তানের বন্ধন একটা আশ্চর্য ব্যাপার, হয়তো সত্যিকারের নিঃশর্ত ভালবাসার একমাত্র ডিসপ্লে, এবং গর্ভোন্মাদনাই তো এই ব্যবসার প্রাণভোমরা, কিন্তু যে গর্ভ ভাড়া দিচ্ছে সে একেবারে ঈশ্বরের পবিত্র-চকগণ্ডি লাফিয়ে পেরিয়ে গেল, তা-ই বা কেন? কোনও মেয়ে যদি টাকার গরজেই এমন ভাবা অভ্যাস করে: মাতৃত্ব আর গর্ভধারণ, দুটো আলাদা জিনিস হতেই পারে? বা, এমনিতেই তার কাছে মাতৃত্ব অমন কিছু একটা বিশাল কাণ্ড নয়, সে অনায়াসেই শরীরের আর একটা উপযোগিতা হিসেবে গর্ভধারণ-ক্ষমতাকে পয়সা তুলতে ব্যবহার করল? এর মানে এই নয়, সেই মেয়েটি বাই ডেফিনিশন এক জন ‘বাজে মা’। ধরা যাক, এক কবি বিজ্ঞাপন দফতরে কাজ করেন এবং বিজ্ঞাপনের জন্য কবিতা লেখেন। আবার বাড়ি ফিরে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় নিজের কবিতা লেখেন। হতেই তো পারে, উনি মনটাকে দুটো কম্পার্টমেন্টে ভেঙে নিয়েছেন। অফিসে টাকার জন্যে, সিরিয়াসলি, কিন্তু অতটা মনের কোর-কুঠুরিকে না ঘাঁটিয়ে লিখছেন। বাড়িতে, হাট করে অন্তরমহল খুলে রাখছেন। তা হলে কেন আমি গর্ভ ভাড়া দেওয়ার সময়ে, সমস্তটা জেনেশুনে, আগে থেকেই এটাকে জাস্ট একটা অফিসকাজ হিসেবে দেখতে পারব না, ন’মাসের শিফ্‌টে?

মুশকিল, এই যে এখন বলা হল কাজটা বন্ধ হয়ে যাবে, টাকার ব্যাপারে বিপন্ন বোধ করলেও, ভেতরে একটা আরাম হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যাক বাবা, আর এটার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না। এ কথা বলব না, যে-বাচ্চাগুলোকে ন’মাস ধরে নিজের মধ্যে বহন করেছি তাদের অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে ঘুম নেই খাওয়া নেই, নাগাড়ে কান্না ঘাই মারছে। না, এ সব হয়নি। কিন্তু এও ঠিক, বাচ্চাগুলোকে ক্লায়েন্টের হাতে তুলে দেওয়ার সময় খুব ভালও লাগেনি। বোধহয় প্রকৃতি এমন একটা বন্দোবস্ত করেই রেখেছেন, আমার ভেতর ভ্রূণ থেকে শুরু করে যে একটা পূর্ণ শিশু হয়ে উঠবে, শরীরের সঙ্গে এই ওতপ্রোত থাকার ফলে তার সঙ্গে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হবেই। মা ও সন্তানের নিবিড় ভালবাসাটা নিশ্চয় প্রাথমিক ভাবে শরীর-অচ্ছেদ্যতা থেকেই আসে। এ সব নির্ঘাত জিন-এর ভেতর বোনা।

ওই যে বলছিলাম, মনটাকে ভাগ করে ফেলব, যতই জোর করে পরদা-পার্টিশন ফেলি না কেন, কোটরগুলোর মধ্যে হাওয়া-চালাচালি হয়, এখানকার জলের কণা ওখানে গিয়ে পড়ে, ওখানকার পোকামাকড় এখানে এসে জ্বালায়। তা ছাড়া হৃদয় ব্যাটা কোনও ম্যানিফেস্টোর ধার ধারে না, খুব খানিক প্রতিজ্ঞা করেও পুরোপুরি তাকে কবজা করা যায় না। তার ওপর এই মা-সন্তানের ব্যাপারটা একেবারে সৃষ্টির প্রথম ও জরুরিতম ইকোয়েশনের সঙ্গে জড়িয়ে— তাই জিন এখানে মনকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে, আশ্চর্য কী? প্রকৃতি যখন একটা কিছু করতে বলে, তার মধ্যে যুগ-যুগের একটা ঠেলা থাকে। তাকে আমরা অস্বীকার করতেই পারি, যে লোক যৌনতাকে অস্বীকার করে সন্ন্যাসী হচ্ছে, সে কি অ-মহৎ কিছু করছে? কিন্তু সেই উলটো-ঠেলায় যেতে অনেকটা কষ্ট হয়। এক যদি সেই চেষ্টাটার মধ্যে খুব খানিক গৌরব অনুভব করি, আলাদা। তা নইলে, কষ্টটা চুঁইয়ে ভেতরে অনেকটা ঢুকে আসে। তাই এখন, কষ্টটা হবে না ভেবে, স্বস্তি হচ্ছে। কে জানে, এ আনন্দ আসলে সংস্কার কি না? মাতৃত্বের স্টিরিয়োটাইপের কাছে নতি কি না? না কি, অ্যাদ্দিন যা করতাম সেটাই ছিল পয়সার দায়ে গা-জোয়ারি অ্যান্টি-স্টিরিয়োটাইপের কাছে নতি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন