কালনার মহকুমা শাসকের বাংলো চত্বর। অনেকের মতে, এখানে ছিল ক্যারল বুশের নীলকুঠি। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল।
নীলচাষের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ অনেক দিনের। সম্ভবত ১৭৭৭ সালে ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড এবং ইংরেজ বণিক কার্ল ক্ল্যাস ভারতে নীল চাষের সূচনা করেন। অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লব এবং তার হাত ধরে বেড়ে ওঠা বস্ত্রশিল্পের কারণেই ইংল্যান্ডে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ইতিহাসবিদের অনুমান, অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকেই নীল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে। ভারতের ঊর্বর মাটিতে নীল ভালই ফলত। ভারতের নীলের উপরে ভিত্তি করেই ১৭৪০ থেকে ১৮০২ পর্যন্ত কোম্পানি বিশ্বের মধ্যে নীলের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করেছিল। এর মধ্যে বাংলার নীলই ছিল শ্রেষ্ঠ। কোম্পানির শাসকরা চাষিদের দিয়ে নীলচাষ করাতেন।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৮১৫-’১৬ সালে বাংলার নীলই বিশ্বের চাহিদা পূরণ করেছিল। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, ১৭৮০ সাল থেকে কোম্পানি সরাসরি নীলচাষ শুরু করে। এবং মুনাফার ভাগ ব্রিটেনে পাঠাতে থাকে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সংসদের আইন ব্রিটেনের যে কোনও নাগরিককে ভারতে এসে নীল চাষের অধিকার দেয়। প্রথমে সাহেবেরা দেশীয় প্রজাদের থেকে জমি কিনে বা ভাড়া নিয়ে নীলচাষ করতেন। পরে চাষিদের উপরে জোর খাটিয়ে নীল চাষ করানো হতে থাকে। ১৮১৫ সালের মধ্যে নদিয়া, পাবনা এবং ঢাকার নানা অঞ্চল নীলকুঠিতে ভরে যায়।
১৮৩০ সাল বাংলা জুড়ে এক হাজারেরও বেশি নীলকুঠি তৈরী হয়। অম্বিকা কালনাতেও নীলকুঠি গড়ে উঠেছিল। শোনা যায়, ১৭৭৮ সালে ক্যারল বুশ নামে এক ইংরেজ সাহেব কালনায় নীলকুঠি তৈরি করেন। ক্যারল বুশের নীলকুঠি যে কোথায় ছিল তা আজ আর ঠিক ভাবে জানা যায় না। কারণ, এর কোনও ধ্বংসাবশেষ আজ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন, এখন মহকুমা শাসকের কার্যালয় যেখানে রয়েছে সেখানেই ছিল বুশ সাহেবের নীলকুঠি।
কালনার জাপট পাড়ার মিশন অঞ্চলেও বেশ কয়েকটি নীলকুঠি ছিল। এ ছাড়া, পাথুরিয়া মহলে কয়েকটি ভগ্নপ্রায় নীলকুঠি আজও দেখতে পাওয়া যায়। এখন সব ক’টিই ধ্বংসের কবলে। ইংরেজ শাসকেরা কালনা ও গুপ্তিপাড়ার চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করেন। লুই বোনাদ নামে ফরাসি নীলকর কালনায় নীলচাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮২২ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পাওয়া সর্বশেষ নথি থেকে জানা যায়, কালনার তাঁর একটি কুঠি থেকে প্রতি বছরে কমপক্ষে ১৪০০ মণ নীল রফতানি করা হত। কালনার পাশে বয়ে চলা ভাগীরথী নদী ছিল এই নীল রফতানির প্রধান পথ। ভাগীরথী থেকে হুগলি হয়ে এই নীল ইউরোপে পাড়ি দিত।
প্রথম দিকে, নীলকরেরা চাষিদের থেকে জমি কিনে বা লিজ নিয়ে নীল চাষ করাতেন। একে বলা হত ‘নিজ আবাদি’। পরে কৃষকদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হত। একে ‘রায়তি বা দাদনি আবাদি’ বলত। চাষি দাদন নিতে না চাইলেও তাঁকে জোর করা হত। ছলে, বলে, কৌশলে এমন ভাবে দাদনের কাগজ তৈরি হত যে এক বার দাদন নিলে তা থেকে বেরিয়ে আসার সাধ্য থাকত না গরীব চাষিদের। পুরুষানুক্রমে নীলের চাষ হত। এতে ইংরেজদের কতটা লাভ হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় ওয়াট সাহেবের দেওয়া হিসেবে। তিনি জানাচ্ছেন, এই সময় নীলকরেরা একশো টাকা দিয়ে নীলচাষ করিয়ে একশো টাকারও বেশি লাভ করত। নীলকরদের নেতা লারমুর সাহেবের দেওয়া নথি থেকে জানা যায়, ১৮৫৮-’৫৯ সালে ২৩,২০০ জন নীলচাষির মধ্যে মাত্র ২৪১৮ জন নীলচাষ করে সামান্য অর্থ পেয়েছিলেন। নীলচাষিদের উপরে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তিনি পঞ্চম আইন করে নীলকরদের প্রভাব খর্ব করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
নীলকরদের এই অত্যাচারের কথা প্রথম জনসমক্ষে আসে ১৮২২ সালের মে মাসে। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। পরে ১৮৪৯ সালে এ বিষয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তার পরেও হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় চলতে থাকে নিয়মিত লেখালেখি। আরও পরে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক। কালনার কৃষকেরাও এই ‘রায়তি’ বা ‘দাদনি’ নির্ভর নীলচাষ ব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন।
দীর্ঘদিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়ান নীলচাষিরা। ১৮৫৯ সালে কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে শুরু হল বিদ্রোহ। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে নদিয়া, মালদা, বর্ধমান, খুলনার মতো নীলচাষের কেন্দ্রগুলিতে। প্রায় ষাট লক্ষ চাষি বর্শা, তলোয়ার, লাঠি নিয়ে বিদ্রোহী হন। কৃষ্ণনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস এবং বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীলচাষ বয়কট অন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদে নামেন। তাঁরা নীলকুঠি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিতে থাকেন।
শোনা যায় কালনার নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্যামল মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি। তিনি ও তাঁর অনুগামীরা দিগম্বর বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন। শ্যামল মণ্ডল ‘মৃত্তিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেখানে নীলকরদের অত্যাচারের কথা ও তার জেরে জনজীবনে ঘনিয়ে ওঠা অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। তবে কালনায় নীলকরদের প্রতি কতটা সশস্ত্র প্রতিরোধ হয়েছিল সে সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেছিলেন, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের তুলনায় নীল বিদ্রোহ জনিত পরিস্থিতি তাঁর কাছে অধিক উৎকণ্ঠার ছিল। নীল বিদ্রোহের পরে ১৮৬০-এ নীল কমিশন স্পষ্ট ভাষায় বলে, ‘নীলকরদের ব্যবসা পদ্ধতি পাপজনক ক্ষতিকারক’। অষ্টম আইনে নীলচুক্তি আইন রদ করে বলা হয়, ‘নীলচাষ সম্পূর্ণ ভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন’। ১৮৯১ সালে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদন শুরু হওয়ার পরে এ দেশে নীলচাষ প্রায় উঠেই যায়।
লেখক কালনার গবেষক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী