পুষ্পকসম: হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলেন রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার বেশে তিন অভিনেতা। অযোধ্যায় দীপাবলি উদ্যাপন। ছবি: পিটিআই
রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ডাল আর রুটি খেয়ে শোয়ার ঘরে চলে এসেছেন আজ নরেন্দ্র মোদী। আজকাল এত তাড়াতাড়ি দিন শেষ করার সুযোগ তাঁর হয় না। দিল্লিতে থাকলে কোনও দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রলম্বিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ অথবা হায়দরাবাদ হাউসে কোনও রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা। এই শীতটা যখন রাজধানীতে আসব আসব করে, তখনই রাষ্ট্রনায়কেরাও রাজধানীতে আসতে শুরু করেন।
আজ সারা দিন তিনি খুব পরিশ্রম করেছেন। সন্ধেয় তুলনামূলক ভাবে চাপ কম। কাল আবার ভোর পাঁচটায় উঠ়বেন, যোগব্যয়াম ও আরও নানা ধরনের শরীর চর্চা। তাই আজ শোয়ার ঘরে এসে ইজিচেয়ারের নরম গদিতে গা এলিয়ে বসে টিভি-র পরদার দিকে তাকিয়ে একটু খবর দেখছিলেন। ব্যক্তিগত সহকারী ওমপ্রকাশ এসে উঁকি মারল। দেখল, ইজিচেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বেশ কিছু আলো নিভিয়ে, শুধু একটু নিবু নিবু আলো রেখে ‘ওপি’ চলে গেল। মোদী নিদ্রা গেছেন।
তার পরই তিনি দেখতে শুরু করলেন সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নটি।
এখনই খবর এসেছে গুজরাতে বিজেপি হেরে গিয়েছে। একদম পর্যদুস্ত। সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে সবাই জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এমন হল? বড় খারাপ লাগছে। ওই একরত্তি ছেলেটা রাহুল গাঁধী, ওঁকে বড় আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম আমরা।
মোদী অমিত শাহর দিকে তাকালেন। অমিত শাহ মাথা নিচু করে রয়েছেন। তার পর জবাব দিলেন নরেন্দ্র মোদী। ‘কী করা যাবে? তিন তিন বার গুজরাতে ক্ষমতায় এসেছি আমি। কিন্তু গত তিন বছর ধরে সেখানে আমি নেই। আর দু’দশক ধরে ওখানে বিজেপি ক্ষমতায়। তা অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি হবে না? তা ছাড়া পটেল-ওবিসি আর মুসলমান সব এক হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে গেল। মেরুকরণের তাসটাও যে কেন কাজ করল না!’
বৈঠকে কারও সাহস নেই প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তোলে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ভাবছেন, কত কাণ্ডই তো করলাম। এখনও তো কত কিছুই করছি। অযোধ্যায় এখনই রামমন্দির না হলেও রামের জন্মস্থানকে পর্যটন মানচিত্রে এনেছি। তাজমহলকে বাদ দিয়ে অযোধ্যাকে তুলে ধরার ব্যবস্থা করেছি গোটা পৃথিবীর কাছে। তাজমহল বিতর্কটাও জমে গিয়েছে। সংঘপরিবার খুশি, নতুন করে ইতিহাস রচনা করা হবে। বাবর-আকবর, আওরঙ্গজেব এ সব নাম বাদ দিয়ে রাম থেকে কৃষ্ণ, মহারাণা প্রতাপ থেকে শিবাজি রাও-এদের পাল্টা ইতিহাস রচনা হবে। তাজমহলে শিবের মন্দির ছিল কি না তা নিয়ে ইতিহাস পরিষদ সরকারি খরচে গবেষণা করবে। ধর্মীয় ঐশী উন্মাদনা হিন্দুত্বর ভাবাবেগ দিয়ে দেশের আবহকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী করে তুলেছি।
আর শুধু তো ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, উন্নয়নের ঝড় তুলেছিলাম ভোটের মুখে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে সোজা আমদাবাদে এনে বুলেট ট্রেনের স্বপ্নর পণ্য বেচে দিয়েছি। শুধু কি তাই, অরুণ জেটলিকে দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, দেশে উন্নয়নের তুফান চলছে। জাতীয় সড়কের মালা, কালো টাকা বিরোধী দিবস পালন, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন, ‘না খাব, না খেতে দেব’-র এই স্লোগান এখন জনগণেশের রক্তস্রোতে আন্দোলিত। এই অসাধারণ প্যাকেজে আচ্ছন্ন সংবাদমাধ্যম। তাই ঝাড়খণ্ডের গ্রামে এগারো বছরের মেয়ে সন্তোষী কুমারী না খেতে পেয়ে মারা গেলেও তা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাই প্রচার হয়নি বৃহৎ সংবাদমাধ্যমে। আধার কার্ড না থাকায় রেশন কার্ড ছিল না, তাই বাড়িতে খাদ্য ছিল না।
যে দিন সন্তোষীর মৃত্যুর খবর এল সে দিন টেলিভিশন সন্তোষীর মৃত্যুর মতো একটি তুচ্ছ ঘটনাকে না দেখিয়ে পুরাণকেই সত্য করে তোলার খবর দেখাতেই ব্যস্ত ছিল। হেলিকপ্টার নামক পুষ্পকরথে করে অযোধ্যায় নামলেন রামচন্দ্র, ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও সীতা। সরযূ নদীর তীরে মোট ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ২১৩টি প্রদীপ জ্বেলে রেকর্ড সৃষ্টি হল। গোটা বিশ্বের নানা দেশে আর্থিক অসাম্যের উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে আর্থিক অসাম্যে ভারত এখন ১৩৫তম স্থানে। মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩০তম স্থানে। আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খেল, বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যসূচকে পরিবর্তন এনেও। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১১৯ দেশে ক্ষুধার উপর সমীক্ষা চালায়। ভারত ১০০ নম্বরে। কোন পাপিষ্ঠরা বিশেষজ্ঞ সেজে এ সব রিপোর্ট বানিয়েছে কে জানে! তবু ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী আর ‘মোদী হেট ইন্ডাস্ট্রি’ও কিন্তু এ সব প্রচার তুঙ্গে তুলতে পারেনি। এখনও তাই মানুষ বল্লভভাই পটেলের সুউচ্চ মূর্তি নির্মাণের আবেগে আর্থিক অসাম্যের পরিসংখ্যান ভুলতে পেরেছে। গো রক্ষকদের তাণ্ডবেও ও সব আজেবাজে পরিসংখ্যান হারিয়ে গিয়েছে।
১০% মানুষ ৮০% ভারতীয় সম্পত্তির মালিক। ও সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। জিএসটি আর নোট বাতিল কর্মসূচি সফল বলে চিৎকার করো। তা হলে এত সফল ভাবে জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও গুজরাতে এ ভাবে হেরে গেলাম কেন?
হঠাৎ ঠিক এই সময়ে ঘুমটা ভেঙে গেল মোদীর। রাত বারোটা। কি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। তিনি চিৎকার করছিলেন, কেন? কেন এমন হল? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ও পি এসে ওঁকে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। এ বার ঘুমিয়ে পড়ুন।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী। আরে দুর! গুজরাতে তো এখনও ভোটই হয়নি। হারব কেন! আবার জিতেই ছাড়ব। সাংবাদিকদের বলেছি গুজরাত ভোট ‘পরম সুখ।’ সেটাই হবে।
বাট্রান্ড রাসেলের বই ‘নাইটমেয়ার্স অব এমিনেন্ট পার্সনস অ্যান্ড স্টোরিজ’। ১৯৫৪ সালে লেখা সে এক ব্যঙ্গ কৌতুকের বই। স্তালিন থেকে আইজেনহাওয়ার— নানা ব্যক্তির দুঃস্বপ্ন নিয়ে সে ছিল কল্পিত দশটি ব্যঙ্গ রচনার অসাধারণ এক সংকলন। স্তালিনের দুঃস্বপ্নে তিনি লিখেছিলেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁকে এক গোপন ডেরায় বন্দি করা হয়েছে। লংকা মেশানো ভদকা খেতে খেতে স্তালিন সেই দুঃস্বপ্ন দেখেন। রাসেলের রচনাটি যখন প্রকাশিত হয় তার এক বছর আগে স্তালিন মারা গিয়েছেন। স্তালিন যদি বেঁচে থাকতেন তবে কি তিনি লন্ডনে রাশিয়ার পুলিশ পাঠিয়ে রাসেলকে গ্রেফতার করতেন?
পাঠক এই লেখাকে রাসেল থেকে চুরি বলে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না আশা করি। তবে সময় খুব খারাপ যাচ্ছে। বৈদ্যুতিন চ্যানেলের রসিকতার অনুষ্ঠানে মোদীজির কণ্ঠ নকল করায় এক কমেডিয়ানের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত মোদী সরকার। আশা করি এই রচনাটি পড়ে আমাদের সকলের সঙ্গে মোদীজিও একই ভাবে হো হো করে হাসতে পারবেন। যে ভাবে তিনি অতীতে পিঠে সজোরে চাপড় মেরে হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হাসতেন।