শিল্পী: বাড়ির সামনে। —ফাইল চিত্র।
নিজেকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসতেন। হাসতে হাসতে বলতেন, জন্ম আমার ঘোর অমাবস্যায়। পাড়া-প্রতিবেশী তো নিশ্চিত ছিল, এ যে ডাকাত না হয়ে যায় না। তার পরেই সংযোজন, পড়শির কোনও ক্ষতি আমি করিনি বটে। কিন্তু জন্মের পরে পঙ্গপালের হানায় এলাকায় চাষের খুবই ক্ষতি হয়েছিল।
বিজয় মাহাতো (জন্ম ২ নভেম্বর, ১৯৫৫— মৃত্যু ২২ জুন, ২০১৯) ছিলেন এরকমই। জঙ্গলমহল, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার বিস্তৃত অঞ্চলে যিনি ‘ঝুমুর সম্রাট’ নামে পরিচিত ছিলেন। জীবনের ছোট ছোট ঘটনা থেকে সমাজ-পরিবেশে ঝড় তোলা বিষয়— সব কিছুতেই তাঁর সমান নজর। সেই দেখার চোখেই তো হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গলমহলের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মনের কথক।
জন্ম জামবনি ব্লকের কাদোপিন্ডরা গ্রামে। গ্রাম জীবনের যা কিছু শৈল্পিক সম্পদ তা এক এক করে নিজের করে নিয়েছিলেন। গরু চরানোর সময়ে আড় বাঁশি বাজানো শিখে নিয়েছিলেন মামা রবীন্দ্রনাথের কাছে। সন্ধ্যেবেলায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করা মানুষগুলো আখড়াতলায় জমতেন ঝুমুর গানে ক্লান্তি দূর করতে। শুনতেন ছোট্ট বিজয়। কান তৈরি হতো। কথায়, সুরে গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টে মনে জমত সৃষ্টির পলি। আর বাড়িতে? শিল্পের কাছে নিবেদিত প্রাণ বাবা শিবচরণ। লোকশিল্পী এবং খেতমজুর। ছৌ নাচ এবং কাঠি নাচের শিল্পী। নাচের দল করার নেশায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন শেষ সম্বল চাষের জমি। মা সরস্বতীর গলায় শোনা মকর, বাঁদনা পরবের গান তাঁকে মোহিত করত। চিচিড়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় কাকাদের থেকে কীর্তন শেখেন।
ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিক স্নাতক। পেশাগত জীবনে বিচিত্রচারী। চিচিড়া হাইস্কুলে এক বছর ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে শিক্ষকতা করেছিলেন। আবার জঙ্গলমহল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তখন পাতাল রেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কাজ নিলেন ঠিকাদারের অধীনে। থাকতেন শ্রমিক বস্তিতে। অবশ্য সেই সময়ে একটা উপকারও হয়েছিল। বিজয় মাহাতোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল গানের শিক্ষক সুনীল চক্রবর্তীর সঙ্গে। শ্রমিক বস্তিতে আড় বাঁশির সুর শুনে আলাপ করে যান তিনি। জীবনের অন্যতম বাঁকও কলকাতাতেই। ঘটনাচক্রে। ১৯৮১ সালে শহিদ মিনারে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে সামিলদের জমায়েত। সভায় বিলি হচ্ছিল একটি পুস্তিকা। তাতে ভবতোষ শতপথীর কবিতা, ‘‘তীক্ষ্ম পাটন (তির) করে টনটন, নগ্ন টাঙির ধার। প্রতিশোধ নিতে পশুবলি দিতে উদ্যত হাতিয়ার’।
নরেন হাঁসদা, মনোরঞ্জন মাহাতোদের বক্তৃতা শুনে বিজয়ের মনে হয়েছিল, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য আন্দোলন হচ্ছে আর তিনি কলকাতায় মাটি কাটছেন! সব ছেড়ে চলে এলেন ঝাড়গ্রামে। আন্দোলনের শরিক হলেন। সেই স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, ‘মাথায় ফেট্টি বেঁধে, হাতে টাঙ্গি নিয়ে গান গাইতে গাইতে মিছিল করতে দেখেছি বিজয়বাবুকে।’’ সেই গানই হয়তো ছিল ‘তীক্ষ্ম পাটন (তির) করে টনটন, নগ্ন টাঙির ধার’।
ধার বাড়ল বিজয় মাহাতোর গানে। লেখায়। এক এক করে গাইলেন জনপ্রিয় সব গান, সুনীল মাহাতোর লেখা, ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন, পালাব পালাব মন নেংটি ইঁদুরে ঢোল কাটে। বতরে পীরিতি ফুল ফোটে’। ভবতোষ শতপথী লিখেছিলেন, ‘একটা ধমসা বনাই দে, একটা মাদল কিনে দে’।...হামি গাইব বাজাব, মইচ্ছা পড়া জীবনটাকে বেদম পাজাব। টাটকা খরা ভখে মরা দেখুত আকালে। অখাড়ে কী জাহান দিব এতই সকালে’। ঝাড়গ্রামের গীতিকার লক্ষ্মণ রায়ের গানও গেয়েছিলেন, ‘শুনগো বাবু বহুবিটি। জলজঙ্গল হামদের মাটি, বাপের ভিটা বিকাঁঞ দিব নাই হে। অধিকারটা ছাড়াঞ লিব ভাই’। নিজের লেখা গান, ‘ঝাড়গাঁর হাট যাতে বেহায়ে ধরল হাতে। ও বেহাই ছাড়ো হাত, ঝুড়ি-ঝাঁটি বিকেঁই সাঝের ভাত’।
সব গানেই জনজীবনের লড়াইয়ের কথা। বিজয় মাহাতো কেন জঙ্গলমহলের কথামুখ? শুধু লড়াইয়ের গানের জন্য? সেটা একটা দিক বটে। কিন্তু অন্য দিকটির কথা বলছিলেন ইন্দ্রাণী মাহাতো। প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী। বলছিলেন, ‘‘আমি কোনও গান সুর করতে গেলে দেখি উনি কতদিন আগে কাজ করে গিয়েছিলেন। ঝুমুরের সুর তাঁর রক্তে।’’ সেই জন্যই বোধহয় ঝাড়গ্রাম শহরের মধুবন এলাকায় রাস্তার ধারে তাঁর বাড়ির নাম ‘ঝুমুর ভবন’। দরজার গায়ে লেখা ‘মাদল’। ইন্দ্রাণী জানালেন, ঝুমুর গান গেয়ে তাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু সেই চলার পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন বিজয় মাহাতো। একসময়ে সাইকেলে করে গান গাইতে যেতেন। বাঁধা মঞ্চ ছিল না। গাছতলাতেও আসর বসিয়েছেন।
সুললিত কণ্ঠ, প্রতিবাদী মুখ সব সত্য। কিন্তু বিজয় মাহাতোর কৃতিত্ব আর একটি জায়গাতেও। তাঁর গান একই সঙ্গে জঙ্গলমহলের মানুষের ‘আঁতের কথা’। আবার সেই গানই শহুরে তথাকথিত মার্জিত শ্রোতার কাছে কবিত্ব, মাধু্র্য আর কথায় কালোত্তীর্ণ সঙ্গীত। তাই মঞ্চে আসছেন বিজয় মাহাতো ঘোষণণা হলে শ্রোতারা উত্তাল হতেন। আবার তিনিই যখন গাইতেন, ‘জমিদারবাবু জমিদারবাবু দু’টা টাকা মদ খাতে দে’। গানের মর্মার্থ, জমিদার তুই তো জমি জায়গা সবই নিলি। দুঃখ ভুলতে মদ খাওয়ার টাকা দিতে হবে জমিদারকেও। এ গান স্পর্শ করবেই সব ধরনের শ্রোতাকে।
শিল্পীরা দূরদর্শী হন। বিজয় মাহাতোর সেই দৃষ্টি ছিল। একটি গানের কথা উল্লেখ করলেন ইন্দ্রাণী। ‘লালগড়ে লালমাটি যত পালায় বহু বিটি, আরও পালায় বনের ভালুক। ছাতি ধুকধুক। ছেইলার বাপে ধরেছে বন্দুক’। গানটি ১৯৮৪ সালে লেখা। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সময়ে। অথচ এই গান অনায়াসে ২০০৯-১০ সালের উত্তপ্ত জঙ্গলমহলের সঙ্গে মেলে। এই যে জঙ্গলমহলের প্রতিটি পরিবর্তন, রাজনৈতিক সচেনতা তাঁর গানে, সে জন্য কী ক্ষতি হয়েছে শিল্পীর? ভুগতে হয়েছে সরকারি স্বীকৃতির অভাবে? সে কথা বিশ্বাস করেন না গবেষক মধুপ দে। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘রাজনৈতিক পরিচয়, মতাদর্শ থাকতে পারে। সে জন্য তাঁকে কোনও ভাগে ফেলা ঠিক নয়। উনি কিন্তু সারা জীবন ধরে মানুষের কথা বলেছেন। নিজের লেখা এবং গাওয়া গানে।’’ ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন বিজয় মাহাতো।
স্বীকৃতি না পাওয়ায় অভিমান ছিল। ঘরোয়া ভাবে এবং মঞ্চেও বলতেন সেকথা। বলছিলেন অধ্যাপক ফটিকচাঁদ ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় প্রতি অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করতেন, ‘পদ্মশ্রী’রা সকলেই কি শহরে থাকেন? গ্রামাঞ্চলে কেউ থাকেন না!’’ সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সরকারি ভাবে তাঁকে অনুষ্ঠানে ডাকা হত না। বলতেন কেন তাঁকে দরখাস্ত করতে হবে সরকারি অনুষ্ঠান পেতে?’’ অথচ ঝুমুর গান বাঁচাতে বেসরকারি ভাবে গীতিকার লক্ষ্মণ রায়ের সঙ্গে ‘ঝুমুর সঙ্গীত সম্মিলনী ও অ্যাকাডেমি’ গড়েছিলেন। কিন্তু সেই সংস্থার জীবন স্থায়ী হয়নি। সকলেই চান, স্বীকৃতি না মিলুক, যদি গানগুলো সংরক্ষণ করা যায়।
শেষ কয়েক মাস ভীষণই অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি ভবতোষ শতপথীর মৃত্যু দিবস পালন অনুষ্ঠানে সেজন্যই তাঁকে গান গাইতে বলা হয়নি। নিজেই গান করেন। গান শেষে হাঁফাচ্ছিলেন। মরচে পড়া জীবনটাকে ‘বেদম পাজাতে চেয়েছিলেন’। কিন্তু আচমকাই ডাক এসে গেল ‘পিঁদাড়ের পলাশবনের’।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।