মহাবীরের বিচরণক্ষেত্র যোগীপাহাড়ি

বীরভূমে পাঁচ-পাঁচটি শাক্তক্ষেত্র এবং অনেক বৈষ্ণবক্ষেত্রের পাশাপাশি একটি জৈনক্ষেত্রও আছে। জৈনদের কাছে এই স্থানটি তীর্থক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত। সারা বছর এখানে জৈনধর্মের মানুষেরা আসেন ভগবান মহাবীরের প্রতি প্রণাম নিবেদন করতে। যোগীপাহাড়ি নামে খ্যাত এই স্থানে মহাবীরের পদচিহ্ন পড়েছিল এবং মহাবীরের জীবনের একটি ঘটনার সঙ্গে এই স্থানের স্মৃতি জড়িত। লিখছেন বিজয়কুমার দাস।বীরভূমে পাঁচ-পাঁচটি শাক্তক্ষেত্র এবং অনেক বৈষ্ণবক্ষেত্রের পাশাপাশি একটি জৈনক্ষেত্রও আছে। জৈনদের কাছে এই স্থানটি তীর্থক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত। সারা বছর এখানে জৈনধর্মের মানুষেরা আসেন ভগবান মহাবীরের প্রতি প্রণাম নিবেদন করতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩২
Share:

তীর্থক্ষেত্র: এই বৃক্ষ ঘিরেই রয়েছে প্রচলিত ধারণা।

বীরভূমের বোলপুর, সাঁইথিয়া, সিউড়ি, রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই— সর্বত্র বহু জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। এঁদের অধিকাংশই মূলত জড়িত ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে। জৈন সম্প্রদায়ের এই মানুষেরা খুব স্বাভাবিক কারণেই মহাবীরের অনুগামী। জৈনধর্মের চব্বিশ তম তীর্থঙ্কর মহাবীরকে তাঁরা ‘ভগবান মহাবীর’ বলে থাকেন। বীরভূমে পাঁচ-পাঁচটি শাক্তক্ষেত্র এবং অনেক বৈষ্ণবক্ষেত্রের পাশাপাশি একটি জৈনক্ষেত্রও আছে। জৈনদের কাছে এই স্থানটি তীর্থক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত। সারা বছর এখানে জৈনধর্মের মানুষেরা আসেন ভগবান মহাবীরের প্রতি প্রণাম নিবেদন করতে। যোগীপাহাড়ি নামে খ্যাত এই স্থানে মহাবীরের পদচিহ্ন পড়েছিল এবং মহাবীরের জীবনের একটি ঘটনার সঙ্গে এই স্থানের স্মৃতি জড়িত। এই স্থানটির মাহাত্ম নিয়ে নানা লোককথা জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন।

Advertisement

সাঁইথিয়া থেকে পটেলনগর হয়ে সিউড়ি যাওয়ার পথে আঙ্গারগড়িয়া মোড় থেকে ডেউচার দিকে গেলে উসকা (লোকমুখে উসকো) নামে একটি ছোট্ট গ্রাম আছে। শোনা যায়, অতীতে এই গ্রাম কৌশিকা নামে পরিচিত ছিল। সেই গ্রামের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে জঙ্গলঘেরা একটি নির্জন স্থান। একশো ফিটের বেশি উঁচু মাটির ঢিবির উপরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মহাবীরের প্রতীকী পদচিহ্ন। শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে সেই প্রতীকী পদচিহ্ন। প্রতি বছর জেলার বিভিন্ন প্রান্তের জৈন ধর্মের মানুষেরা আসেন ২৩ জানুয়ারি এখানে মহাবীরকে প্রণাম জানাতে। সারাদিন হোম যজ্ঞ পুজো পাঠ হয়। ১৯৮৯ সালের ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই প্রতীকী পদচিহ্ন। বর্তমানে এই স্থানের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সাঁইথিয়ার সুশীল কোচর বললেন, ‘‘জৈনগ্রন্থ আগম সূত্রে জানা যায়, এই স্থানটি ছিল মহাবীরের বিচরণক্ষেত্র।’’ উল্লেখ করা যেতে পারে, এখান থেকে কিছু দূরে বিহারের ক্ষত্রিয়কুণ্ডে রাজা সিদ্ধার্থর পুত্র মহাবীরের জন্ম হয়েছিল।

উসকা গ্রামের কাছের গ্রামগুলিতে খুব দরিদ্র পরিবারের মানুষের বাস। আদিবাসী এবং চাষি পরিবারই বেশি।। দীর্ঘদিন থেকে এই এলাকার লোকমুখে ঘুরত মহাবীরকে নিয়ে নানা কাহিনি। শোনা যেত, বিষধর এক সাপের নিঃশ্বাসে এলাকায় তখন ফসল হত না। মানুষ তো দূরের কথা, কোন জন্তু জানোয়ারও যেতে পারত না সেখানে। দিগম্বর যোগী মহাবীর আত্মশুদ্ধির জন্য ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে পৌঁছেছিলেন এবং এই নির্জন স্থানে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন।

Advertisement

সাঁইথিয়ার জৈন সম্প্রদায়ের ভোজরাজ পারখ নানা গ্রন্থ ঘেঁটে এই প্রচলিত লোককথার সত্যতা প্রমাণে ব্রতী হন। স্থানটিকে চিহ্নিত করে সেটি জৈনক্ষেত্র হিসাবে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য অনশন আন্দোলন পর্যন্ত করেছিলেন সরকারি দফতরে। সে সময় রাজ্যের মন্ত্রী বিজয়সিংহ নাহার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন। এলাকাটির লিজপ্রাপক ছিলেন সেই সময়ের আর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অবিনাশপুরের বৈদ্যনাথ বন্দোপাধ্যায়। তাঁর কাছ থেকে জমিটি গ্রহণ করা হয়। শুরু হয় জৈন সাধু সন্তদের আসা যাওয়া। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় মহাবীরের প্রতীকী পদচিহ্ন। পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি তৈরি হয়। ঘিরে দেওয়া হয় সেই বৃক্ষের অবস্থান অঞ্চল, যার নীচে ধ্যানরত অবস্থায় চণ্ডকৌশিক সাপ মহাবীরকে দংশন করেছিল বলে কথিত। পরবর্তীতে সাঁইথিয়ার ফুসরাজ পুগলিয়া, নির্মল রাঙ্কা, অভয় চতুর্মুথা প্রমুখ এই স্থানটির নানা উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নেন।

জানা গেল, কলকাতার পঞ্চায়েতী মন্দির নামে একটি ট্রাস্টের অধীনে এখন এখানে নানা উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।৩০ বিঘা জমি সংরক্ষণ করে ঘেরা হয়েছে সীমানা প্রাচীর দিয়ে।নির্মিত হবে বিশাল জৈন মন্দির, ৪০ কক্ষের ধর্মশালা,উপাসনাকক্ষ।প্রতিষ্ঠা করা হবে মহাবীর ও চন্ডকৌশিক সাপের বিগ্রহ।

একদা প্রচলিত লোককথা এখন জৈন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ঐতিহাসিক সত্য। মহাবীর সংসার ছেড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছিলেন। মহাবীরের জীবন থেকে জানা যায়, তিনি বিভিন্ন নির্জন স্থানে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন। অহিংসা, ক্রোধ দমনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা। এ কাহিনি আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগের। এই নির্জন এলাকায় ছিল একটি নিমগাছ ও বটগাছ। সেখানে মহাবীর ধ্যানস্থ হলে সাপ তাঁকে দংশন করে। কিন্তু দংশনের পরে দেখা যায়, মহাবীরের শরীর থেকে রক্তের পরিবর্তে দুধ বের হচ্ছে। এই দংশনের পরেও মহাবীর নির্বিকার থেকে চণ্ডকৌশিক সাপকে ক্রোধ দমন করার উপদেশ দিয়ে মনে করান, এই সাপ পূর্বজন্মে ছিলেন এক ক্রোধী মুনি। ক্রোধের কারণেই পরজন্মে তিনি সাপ হয়েছেন। পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ায় সেই সাপ মহাবীরের পায়ের কাছে লজ্জায় মুখ গুঁজে দেয় মাটিতে। দীর্ঘদিন এই অবস্থায় ছিল চণ্ডকৌশিক। এলাকার মানুষ নানা ভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করলেও সে ফণা তোলেনি। সেই অবস্থায় তার শরীরের চামড়া খসে পড়েছিল। সেই অবস্থাতেই সে মারা যায়।

এই লোককথার ওপর ভিত্তি করেই সাঁইথিয়ার ভোজরাজ পারখ তাঁর গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, এই স্থানই মহাবীর স্মৃতিধন্য সেই স্থান। এ প্রসঙ্গে উপযুক্ত তথ্যসহ তিনি বইও প্রকাশ করেছিলেন।

এখন মহম্মদবাজার ব্লকের অধীন পুরাতনগ্রাম ও দ্বারকা নদী সংলগ্ন এই স্থানটি খড়িমাটি শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানকার সংলগ্ন এলাকার মাটি খুঁড়লে খড়িমাটি পাওয়া যায়। এলাকার মানুষ এখনও মনে করেন, চণ্ডকৌশিকের দংশনে মহাবীরের শরীর থেকে যে দুধ বেরিয়েছিল, তার ফলেই এলাকার মাটি সাদা হয়ে গিয়েছিল। সুশীল কোচর দিনরাত এক করে পড়ে আছেন এখানে। তিনি জানাচ্ছেন, সারা রাজ্যের জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ অর্থ সাহায্য করছেন। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে মহাবীর স্মৃতিধন্য যোগীপাহাড়ী হয়ে উঠবে এ রাজ্যের অন্যতম জৈন তীর্থক্ষেত্র।

লেখক নাট্যকর্মী ও প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক (মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন